প্রবাসী বন্ধুর ফেসবুক পোস্ট পাল্টে দিলো

রাজনীতির সমীকরণ, এলাকা ছাড়া মেয়র

প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭:৪৩ | অনলাইন সংস্করণ

  বিশেষ প্রতিবেদক

মধুর সম্পর্ক ছিল দু’জনের! রাজনীতির মাঠে দীর্ঘ সময় হেঁটেছেন পাশাপাশি। দেশ ও দেশের বাইরে-ছিলেন আড্ডার সঙ্গী। মাস কয়েক আগেও ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনের সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ বাবেলের ‘ডান হাত’ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো গফরগাঁও পৌরসভার মেয়র এস এম ইকবাল হোসেন সুমনকে। কিন্তু সুমনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রবাসী এক বন্ধুর ফেসবুক পোস্ট পাল্টে দিলো রাজনীতির গতিপথ আর সমীকরণ। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উবে গিয়ে ঠেকলো শত্রুতায়। সংসদ সদস্যের অগ্নিমূর্তিতে এখন জেরবার টানা দু'বারের নির্বাচিত মেয়র সুমন। 

প্রথমে সংসদ সদস্যের লোকজনের হুমকি-ধমকির পর ধারাবাহিকভাবে তাঁর অনুসারীদের বাড়ি-ঘরে হামলা, ভাংচুর ও তাণ্ডবের মুখে প্রাণভয়ে গফরগাঁও ছেড়ে আসতে বাধ্য হন তিনি। প্রায় ৬ মাস যাবত অনুপস্থিত পৌরসভায়। ততক্ষণে জল গড়িয়েছে অনেক দূর। ভয়ভীতির বাইরেও কায়দা-কানুনেও মেয়রকে ‘সাইজ’ করতে চেনা সেই স্টাইল ‘অভিযোগ থেরাপি'। ৭ বছরের মেয়র জীবনে এতোদিন কোন টু শব্দ না হলেও এবার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ১১ কাউন্সিলরের অনাস্থা! মূলত দুর্নীতির অভিযোগের ফাঁদে ফেলে পছন্দের ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ভারপ্রাপ্ত মেয়র’ করতেই এমন কূটকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে। 

যদিও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও মেয়রের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে আনীত অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র। প্রায় দু'সপ্তাহ আগে তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন ময়মনসিংহের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (উপসচিব) মো.শফিকুল ইসলাম। 

হঠাৎ কী কারণে দীর্ঘদিনের গাঁটছড়া আলগা হওয়া আর তিক্ততার সূত্রপাতই কীভাবে জানতে চাইলে গফরগাঁও পৌরসভার মেয়র এস এম ইকবাল হোসেন ফিরে যান চলতি বছরের ২৭ মার্চের একটি ঘটনায়। ওই দিন ছিল তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনে শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহকর্মীদের ফেসবুক পোস্টে অনবরত শুভেচ্ছা পাচ্ছিলেন। সেই কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'ওইদিন আমার ফ্রান্সপ্রবাসী বন্ধু ইনসাফ সুমন ভূঁইয়া আমাকে ফেসবুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেন ‘শুভ জন্মদিন বন্ধু। ভবিষ্যতে তোমাকে এমপি হিসেবে দেখতে চাই।’ আমি পোস্টটি পুরোপুরি না দেখে তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।’ এই পোস্টে রেগে অগ্নিশর্মা সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ। তিনি ভেবেছেন আমি আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চাইবো। আমি অনেকবার তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়েছি। তাকে নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছি সংসদ সদস্য হওয়ার কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই আমার। কিন্তু তিনি মানতে নারাজ।' 

মেয়র সুমন অনুসারী স্থানীয় নির্যাতিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজের বিরোধীতা সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু আমরা তার বিরোধীতা না করলেও শুধুমাত্র মেয়রের অনুসারী হওয়ায় প্রায় অর্ধ-শতাধিক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হামলা-নির্যাতন আর তান্ডবে এলাকা ছেড়ে ময়মনসিংহ, ভালুকা ও ঢাকায় থাকছেন। 

সংসদ সদস্যদের ক্যাডারদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন গফরগাঁও পৌর এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা নয়ন মাহমুদ (২৮)। তিনি মেয়র সুমনের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। গত ঈদুল আজহার দিনে তাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে আহত করা হয়। তিনি বলেন, 'পান থেকে চুন খসলেই কুপিয়ে বা নির্যাতন করে এলাকাছাড়া করেন সংসদ সদস্যের সন্ত্রাসীরা। এখানে তাঁর ক্যাডারদের হাতে গোটা আওয়ামী লীগ জিম্মি।' 

'অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বাঁচতে শর্ত ছিল নিজের মালিকানাধীন ইটভাটা সংসদ সদস্যের নামে লিখে দেওয়া। আমি তাঁর নামে স্ট্যাম্পে ইটভাটা লিখে দিয়ে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমে গ্রামের বাড়িতে ও পরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। ওরা জোর করে ৬ টি খালি স্টাম্পে আমার স্বাক্ষর নিয়েছে'-ক্ষোভ আর আতঙ্কের মিশেলে কথাগুলো বলছিলেন গফরগাঁও পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক তাজমুন আহমেদ। তিনি বলেন, 'সংসদ সদস্যের অপছন্দ হলেই হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়। ঘরবাড়ি ভাংচুর করা হয়। আমার মতো আরও অনেকেই সংসদ সদস্যের লোকজনের নির্যাতনে পিষ্ট। আমরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও রেহাই মেলে না।’

সংসদ সদস্যের নির্দেশে সব কাউন্সিলররা মেয়রের বিরুদ্ধে অনাস্থার কাগজে স্বাক্ষর করলেও একমাত্র ব্যতিক্রম স্থানীয় ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাবুল হোসেন। এজন্য বড় খেসারত দিতে হয়েছে তাকে। কাউন্সিলর বাবুল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, 'আমি অনাস্থায় রাজি না হওয়ায় আমার বাসায় হামলা হয়েছে। এ হামলার ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজও রয়েছে। আমি এখন আমার পরিবার নিয়ে প্রাণনাশের ভয়ে ময়মনসিংহ শহরে বসবাস করছি।' 

তবে নির্যাতনের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন সংসদ সদস্যের অনুসারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক  আবুল কাশেম। তিনি বলেন, 'সংসদ সদস্যের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। গফরগাঁওয়ে আওয়ামী লীগ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী।' সংসদ সদস্য ও মেয়রের দ্বন্দ্বের বিষয়ে তিনি বলেন, 'এমপির সাথে মেয়রের বিরোধের অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তীহীন। মূলত পৌর কাউন্সিলরদের সাথে মেয়রের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। এ কারণেই তারা তাকে অনাস্থা দিয়েছে। এতে এমপি বা দলের কোন সম্পৃক্ততা নেই।' 

স্থানীয় সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ বাবেলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্প্রতি আলাপে সরকার দলীয় এই সংসদ সদস্য দাবি করেছেন, 'ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে মেয়রের সঙ্গে আমার কোনো মতবিরোধের ঘটনা ঘটেনি। সে মেয়রের দায়িত্ব পালনের শুরু থেকে নানা অনিয়ম করে আসছে। তাই কাউন্সিলররা তার প্রতি অনাস্থা দিয়েছে। সেই ভয়ে সে গফরগাঁও ছেড়েছে। কারও বাড়িতে কোনো ধরণের হামলার ঘটনাও ঘটেনি। এরকম কিছু হলে তাঁরা প্রশাসনের সহযোগিতা নিতে পারতো।'

এবি/ওজি