ইথিওপিয়ায় মুসলিমদের ঐক্য ও ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে আলেমদের ভূমিকা

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১১:২১ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন

খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইথিওপিয়ায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম পরিচয় ও সংস্কৃতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন দেশটির আলেম সমাজ। রাজনৈতিক চাপ, সংস্কৃতিক বঞ্চনা ও প্রশাসনিক তুচ্ছতার মাঝেও তারা কোরআন-হাদিসের আলো ছড়িয়ে মুসলিম সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন।

ইথিওপিয়াকে সাধারণত খ্রিস্টান প্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত করা হলেও বাস্তব চিত্রটি অনেক জটিল। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশটিতে মুসলিমের হার ৩৩ শতাংশ। তবে ইসলামী সংগঠনগুলোর দাবি, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করা হয় না ।

দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ একাধিকবার বলেছেন, আধুনিক ইথিওপিয়া গঠনে ধর্মীয় বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তিনি মুসলমানদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও প্রভাবের কথাও তুলে ধরেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে গঠিত হয়েছে ইসলামিক হাই কাউন্সিল—যা দেশটির ধর্মীয় সম্প্রীতি জোরদারের নতুন উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইসলামী শিক্ষার ধারক আলেম সমাজ

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইথিওপিয়ার আলেমরা ইসলামী জ্ঞান ও ঐতিহ্য রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯শ শতকের শেষদিকে সম্রাট মেনেলিক দ্বিতীয় যখন মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে রাজধানী কেন্দ্রিক শাসনে আনেন, তখন থেকেই গ্রামীণ মুসলমানরা সাংস্কৃতিক বঞ্চনার শিকার হতে থাকে।

উত্তর ইথিওপিয়ার নাজাশি গ্রামে অবস্থিত সাহাবী মসজিদ, যা নাজাশি মসজিদ নামেও পরিচিত 

সে সময় ইসলাম প্রচার ও ইসলামী শিক্ষা রক্ষায় গ্রামের আলেমরাই ছিলেন প্রথম সারির যোদ্ধা। তারা গোপনে কোরআন শিক্ষা দিতেন, ঘরে ঘরে ধর্মীয় পাঠ চালু রাখতেন। মসজিদ ও মক্তবকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন স্বনির্ভর ধর্মীয় নেটওয়ার্ক। যা মুসলিম পরিচয়ের প্রাণশক্তি হিসেবে টিকে আছে আজও।

হরার : ইথিওপিয়ার ইসলামী কেন্দ্র

রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে প্রায় ৫২৫ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত ঐতিহাসিক শহর হরার, যাকে বলা হয় ‘ইথিওপিয়ার আল আজহার’। ১০ম শতাব্দী থেকেই শহরটি ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। এখানে ৮০টিরও বেশি মসজিদ আছে, এর মধ্যে তিনটি ১০ম হিজরী শতাব্দীর নিদর্শন।

হরার শহরের আলেমরা শত শত বছর ধরে ইসলামী পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন শায়খ আবদুল্লাহ আলী শরীফ, যিনি ইসলামী ঐতিহ্য ও সুফি সংস্কৃতির সংরক্ষণে জীবন উৎসর্গ করেন।  ইসলামী সভ্যতার জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে হরারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউনেস্কো।

গ্রামের মাদরাসাগুলো যেন ক্ষুদ্র বিশ্ববিদ্যালয়

ইথিওপিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত ওলো, বালে, আরসি অঞ্চলের মাদরাসাগুলো আসলে ক্ষুদ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। এখানে ফিকহ, তাফসির, নাহু, মানতিকসহ অন্তত ১২টি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। এই পাঠক্রম থেকে শত শত আলেম ও দাঈ বের হয়ে দেশের নানা প্রান্তে ধর্মীয় জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

তাদের মধ্য থেকে উঠে এসেছেন বিশিষ্ট আলেম ফকীহ হাশিম আল হারারি, শায়খ আহমদ বিন সালেহ আরগুবা, শায়খ জামালুদ্দিন প্রমুখ, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইসলামী শিক্ষা প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন।

আধুনিক যুগের আলেম ও নেতৃত্ব

ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় আধুনিক ধারার শিক্ষা ও ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন শায়খ মুহাম্মদ হোসেন। তিনি ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

২০২৫ সালে অনুষ্ঠিত হয় ইসলামী বিষয়ক উচ্চ পরিষদের প্রথম অবাধ নির্বাচন, নেতৃত্ব দেন শায়খ ইব্রাহিম তুফা। এতে অংশ নেন প্রায় ১৩ মিলিয়ন ভোটার, যা দেশটির মুসলমানদের ঐক্য ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

২০২৫ সালের অক্টোবরে মারা যান ইথিওপিয়ার প্রাক্তন গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ হাজী ওমর ইদরিসকে। তার জানাজায় হাজারো মানুষ উপস্থিত হন। যা প্রমাণ করে তিনি কেবল ধর্মীয় নেতা নন, বরং জাতির নৈতিক প্রেরণার প্রতীক ছিলেন।

শিক্ষাই প্রতিরোধের হাতিয়ার

রাজনৈতিক প্রান্তিকতা ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার মাঝেও ইসলামী শিক্ষা ইথিওপিয়ার মুসলমানদের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অস্ত্র হয়ে উঠেছে। আলেমরা স্থানীয় ওরোমো, আমহারিক ও সোমালি ভাষায় কোরআন ও হাদিস অনুবাদ করে ধর্মীয় জ্ঞানকে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন।

এই অনুবাদ শুধু পাঠ্য নয়, বরং মুসলিম পরিচয় সংরক্ষণের একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ। মুসলিম সমাজের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মক্তব, মসজিদ ও দাওয়াহ কেন্দ্রগুলো পরিচালনায় সরকারি সহায়তা না থাকলেও স্থানীয় আলেমরা নিজস্ব উদ্যোগে তা চালিয়ে নিচ্ছেন।

অম্লান আলোকবর্তিকা

ইথিওপিয়ার আলেমরা শুধু ধর্মীয় নেতা নন, বরং সমাজ সংস্কারক ও জাতির পথপ্রদর্শক। তারা জ্ঞান, দয়া, অনুগ্রহ ও ত্যাগের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, ইসলাম শুধু আচার বিধি পালন নয় বরং একটি সাংস্কৃতিক শক্তি যা জাতির মর্যাদা ও পরিচয় রক্ষা করে।

অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা আজও জাগিয়ে রেখেছেন সেই অম্লান আলোকবর্তিকা, যা হিজরতের ভূমি হাবাশাকে মনে করিয়ে দেয় এখানে ইসলাম এসেছে মমতা, জ্ঞান ও ন্যায়ের আহ্বান নিয়ে।

 সূত্র : আল জাজিরা 


আমার বার্তা/জেএইচ