ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশ

প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:২৯ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

মানবিক বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করেছে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের আচেহ প্রদেশে নজিরবিহীন বন্যায়। ঘন কাদা ও পলিমাটির স্তূপের মধ্যে আটকে পড়ে হাজারো মানুষ এখন বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত খাবার ছাড়াই মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

২৬ নভেম্বরের ভয়াবহ বন্যার পর টানা দুই সপ্তাহ ধরে ক্ষতিগ্রস্তরা স্কুল, মসজিদ ও মাদরাসায় গড়ে ওঠা অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে দিন কাটাচ্ছেন। ক্ষুধা, অন্ধকার আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এই তিন নিয়েই চলছে তাদের প্রতিদিনের লড়াই।

বন্যাকবলিত বহু মানুষ এখনও ত্রাণশিবিরের তাঁবুতে অবস্থান করছেন, যেখানে দুই সপ্তাহেও পর্যাপ্ত খাবার ও পানির জোগান পৌঁছায়নি। দুর্গম এলাকায় সহায়তা পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় বিশেষ করে শিশুদের প্রায়ই না খেয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে।

বিরুয়েন জেলার কামপুং রায়া তাম্বো গ্রামের কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত বলেন, কখনও কখনও তিন থেকে চারদিন পর খাবার আসে। মাঝের সময়টুকুতে আমাদের অনাহারে থাকতে হয়।

এই পরিস্থিতিতে গত পরশু থেকে মালয়েশিয়ার মানবিক সংগঠন মুসলিম কেয়ার মালয়েশিয়া (এমসিএম) দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ শুরু করেছে। সংগঠনটি চাল, রান্নার তেল, চিনি, বিস্কুট, শুকনো খাবার, লুঙ্গি, নামাজের পোশাক ও নগদ অর্থ সহায়তা হিসেবে দিয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ফয়সাল বলেন, প্রবল বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট বন্যা শুধু গ্রাম ডুবিয়ে দেয়নি বরং হাজার হাজার ঘরের ভেতরে দুই থেকে তিন মিটার পর্যন্ত পুরু কাদার স্তর জমে গেছে।

তিনি বলেন, সাধারণ বন্যার পর ঘর পরিষ্কার করা যায়। কিন্তু এবারের বন্যা ব্যতিক্রম। এত পুরু কাদা যে কোদাল-শাবল দিয়েও পরিষ্কার করা অসম্ভব। মাসের পর মাস লাগতে পারে। আমাদের বাড়ি ও ফসলি জমি এখন কাদার সমুদ্রে পরিণত হয়েছে। তার মতে, বহু পরিবার এখন আর ঘরে ফেরার কোনো সুযোগ দেখছে না।

আরেক ক্ষতিগ্রস্ত মুন্জা (৩৪), কামপুং রায়া তাম্বোর বাসিন্দা, ২৬ নভেম্বর রাতের ভয়াবহ মুহূর্তের কথা স্মরণ করে বলেন, হঠাৎ প্রবল স্রোতে পানি ঘরে ঢুকে পড়ে। আমাকে স্ট্রোকে আক্রান্ত পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা সুমার্নিকে (৬০) কোলে করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে হয়। আমাদের ঘর এখন আঠালো কাদায় ডুবে আছে। পরিষ্কার করার ক্ষমতা আমার নেই। আমরা আর ফিরতে পারছি না। দুই সপ্তাহ ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা পরিবারগুলোর কাছে এই সময়টুকু যেন শেষ না হওয়া এক দুঃস্বপ্ন।

এমসিএম-এর পরিচালনা পর্ষদ সদস্য তুয়ান আসরি তুয়ান হুসেইন জানান, অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে এবং বিশুদ্ধ পানির চরম অভাব দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, অনেকে শুধু বিস্কুট আর অল্প পানি ভাগাভাগি করে খাচ্ছেন। আমরা যে চাল দিয়েছি, তা সবাই মিলে রান্না করে খাচ্ছেন। বিদ্যুৎ, পানি ও বাসস্থানের অভাবে তারা অত্যন্ত ক্লান্তিকর সময় পার করছেন। তবুও ত্রাণের আশাই তাদের একমাত্র শক্তি।

বিরুয়েন জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার একটি। সেখানে এখনও বিদ্যুৎ ও পানির সংকট প্রকট। প্রায় প্রতিরাতেই মানুষ অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছেন।

বন্যায় আচেহের কৃষিখাতও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু বিরুয়েন জেলাতেই প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর ধানক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি পুরোপুরি কাদায় চাপা পড়েছে এবং সেচব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

আসরি সতর্ক করে বলেন, পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে খাদ্য সংকট আরও বাড়বে এবং হাজারো পরিবার আয়ের উৎস হারাবে। হাসপাতাল, স্কুল ও সরকারি দপ্তর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বহু সেতু ভেঙে পড়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, এই ভয়াবহ বন্যায় এখন পর্যন্ত ৯৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আরও শতাধিক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন।

এমসিএম এরই মধ্যে ৬২৫টি খাদ্য প্যাকেট ও নগদ সহায়তা মিলিয়ে মোট ৭৬ হাজার রিঙ্গিত সমমূল্যের ত্রাণ বিতরণ করেছে। প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দেন এমসিএমর কোষাধ্যক্ষ উস্তাজ আহমদ শুকরি ইসমাইল। সঙ্গে ছিলেন সংগঠনের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজান আসলাম এবং মহাসচিব আহমদ সাফুয়ান উজার।

এছাড়া হারমনি প্রিহাতিন মালয়েশিয়া (এইচপিএম), মুসলিম ভলান্টিয়ার মালয়েশিয়া (এমভিএম) এবং শিফাক ২৪ ঘণ্টা ক্লিনিক গ্রুপের চিকিৎসকরাও সহায়তায় অংশ নিচ্ছেন।

ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা (বিএনপিবি) জানিয়েছে, দুর্গম অঞ্চলগুলোতে স্থল ও আকাশপথে ত্রাণ পৌঁছাতে কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। মোট ১ লাখ ৬৩৮ দশমিক ৯৬ টন ত্রাণসামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সরকার সমর্থিত হাজারো স্বেচ্ছাসেবক দল টাগানা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে দেশটির যোগাযোগ ও ডিজিটাল বিষয়ক মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে কাজ করছে। জানা গেছে, জরুরি দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া অবস্থা ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

আমার বার্তা/এল/এমই