যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে ফের অস্থিরতা

প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৩, ১৫:২৬ | অনলাইন সংস্করণ

  রতন বালো

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে দীর্ঘ দিনেও বাস্তবায়ন হয়নি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ১১৮ জন কর্মকর্তার পদোন্নতি।

এই দুর্র্নীতিবাজ কর্মকর্তা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক (প্রশাসন) মোখলেছুর রহমানকে শাস্তি না দিয়ে বদলি করা হয়েছে। ২৫ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কিছুই করতে পারেননি। ফলে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিতদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।

এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে যুব ভবন থেকে বিতারিত মোকলেছুর রহমান প্রধান কার্যালয়ে প্রত্যাবর্তনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আজাহারুল ইসলাম খান। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাগণ।
অভিযোগ রয়েছে, ২৫ কোটি টাকা লুটপাটের নেপথ্যে রয়েছেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ( ডিজি) মো. আজাহারুল ইসলাম খান ও সাবেক উপ-পরিচালক (প্রশাসন) ও বর্তমান নরসিংদী জেলা উপ-পরিচালক মোখলেছুর রহমান দুজনের একটি দুর্নীতির এক সিন্ডিকেট। তাদের এই দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে আসার পর তা নিয়ে সংসদীয় কমিটি আলোচনায় বসে। সেখানে যুব অধিদপ্তরের এই বিশাল দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সংসদীয় কমিটি। একই সঙ্গে এই চক্রটি আদালতের আদেশ না মেনে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে যে পদোন্নতি দিয়েছেন তারও তীব্র নিন্দা জানানো হয়। নিন্দায় বলা হয়, আদালতের রায় না মেনে এই ধরনের অপকর্ম নিঃসন্দেহে সরকারি অর্থের অপচয় যা আর্থিক দুর্নীতির সামিল। পদোন্নতির আদেশে নীতিমালা ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে চরম হটকারিতা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে দুর্নীতির বরপুত্র মোখলেছুর রহমানের অনিয়মের তদন্ত করেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (যুব-১) কাজী মোস্তাক জহিরন। যুগ্মসচিবের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১১২ জনের ‘চলতি দায়িত্ব’-প্রদান যা চাকরিবিধি অনুযায়ী গুরুতর অনিয়ম। সেখানে দুর্নীতিপ্রবণ এই মোখলেছুর রহমানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মহাপরিচালক  মো. আজাহারুল ইসলাম খান ( গ্রেড-১) কে দায়ী করা হয়েছে। 
ভুক্তভোগীদের দাবি ছিল দুর্নীতিবাজ মোখলেছকে তার কৃতকর্মের শাস্তি। কিন্তু সেটি হয়নি। উপরন্তু তাকে তিরস্কারের পরিবর্তে পুরস্কৃত করা হয়েছে। অভিযোগ থেকে তাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সবধরনের অপরাধ থেকে তাকে কৌশলে অব্যাহতি দিয়েছেন খোদ মহাপরিচালক। যদিও তিনি প্রত্যাহার পত্রটি প্রকাশ্যে আনেননি।  
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা। কমিটির পক্ষ থেকে পদোন্নতির বিতর্কিত আদেশ বাতিল, দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও শূন্য পদে পদোন্নতির জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ওই সুপারিশ করা হয়। কমিটির সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিটির সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী ও এন এম নাইমুর রহমান দুর্জয় এবং সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
কমিটি সূত্র জানায়, বৈঠকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অনিয়ম ও দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে সাবেক উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মোখলেছুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। বলা হয়, ওই কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নীতিমালা এবং আদালত ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানেননি। নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ১১২ জন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাকে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা পদে ‘চলতি দায়িত্ব’ দিয়ে আইনের বিধি লঙ্ঘন করেছেন। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ভিতরে এমন কয়েকজন রয়েছেন, যারা কেবল চাকরিতে জুনিয়রই নন, তাদের পদোন্নতি পাওয়ার মত কোনো দক্ষতা নেই। এদের পদোন্নতির ফলে সরকারের উদ্দেশ্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের বেতনভাতা বাবদ সরকারকে বিপুল অংকের টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। যদিও এই আদেশে  মহাপরিচালক মো. আজাহারুল ইসলাম খান স্বাক্ষর করেছেন। তারপরেও  এই অনিয়মের মূল হোতা মোখলেছুর রহমান স্বয়ং। তিনি তার প্রভাব খাটিয়ে এই অনিয়ম করেছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এদিকে  মোখলেছুর রহমানের বিরুদ্ধে একাধিক বিভাগীয় মামলা থাকলেও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়া অনেকটাই রহস্যজনক বলে মন্তব্য করা হয়েছে। 
বৈঠক সূত্র বলছে, ২০২১ সালের  ২৫ নভেম্বর ১১২ জন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাকে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে এক আদেশ জারি করা হয়। ওই আদেশের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অমান্যের চিত্র প্রকাশ্যে আসে। পরে এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতও ওই আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিলের নির্দেশনা দেয়। ২০২২ সালের ১৮ জুলাই দেয়া আদালতের আদেশটি বাস্তবায়ন না করে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে কিংবা সুবিধাজনক স্থানে তাদেরকে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। এই অনিয়মের কারণে অন্ততঃ ৭০ জন পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আবার ১১৫ জনের পদোন্নতির প্রস্তাব প্রস্তুত থাকলেও তা মহাপরিচালকের অনাগ্রহে তা বাস্তবায়ন গড়িমসি করা হয়।  এবিষয়ে বৈঠকে  ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। 
বৈঠক শেষে সংসদীয় কমিটির সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মোখলেছুর রহমানের অপরাধ এবং তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় কর্তৃক শাস্তিমূলক কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এছাড়া ১১৫ জন উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা পদে অবৈধ চলতি দায়িত্বাদেশ বাতিল করে  জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতির দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আজাহারুল ইসলাম খান এর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করেন নাই। তবে তিনি আজ থেকে তিন মাস আগে অর্থাৎ গত ১০ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন, এখন সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। বর্তমানে কোনো সমস্যা নেই। যত সমস্যা ছিল এখন আস্তে আস্তে সমাধান হয়ে আসছে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। এর বাইরে তিনি কোনো কথা বলেন নাই।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক (প্রশাসন) বর্তমানে নরসিংদী জেলা উপপরিচালক মোখলেছুর রহমান এর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার পক্ষ থেকে কোনো সদুত্তর মেলেনি। তবে তিনি বলেছেন, অভিযোগ সঠিক নয়। একটি চক্র অশুভ কাজগুলো করছেন। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ বিষয়ে তিনি বলেন, এটা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বিষয়। এটাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে বলে মোখলেছ জানান। তিনি এই প্রতিবেদককে খোঁজ নিয়ে জানতে বলেন। এছাড়া তিনি এখন হেড অফিসে নাই বলে এর বাইরে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নাই।
মোখলেছুর রহমানের বক্তব্যকে বিরোধিতা করে কয়েকজন সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,  যুব দপ্তরের সকল কর্মচারীর প্রত্যাশা ঐ চিহ্নিত অপরাধী মোখলেছ এবং স্বয়ং মহাপরিচালকে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানান। তারা বলেছেন, অবিলম্বে চলতি দায়িত্ব বাতিল করে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি প্রদান এবং মোখলেছুরকে আইনের আওতায় এনে অপরাধের এবং অপরাধীর বিচার হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তোভোগি সহকারী যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাগণ জানান। 

এ বিষয়ে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এর সঙ্গে মুঠোফোনে দুই দফায় যোগাযোগ করা হলে তিনিও এ বিষয়ে কোনো কথা বলেন নাই।