জনস্বাস্থ্যে মন্ত্রীর ফোনই তাহেরের ক্ষমতা!

প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৩, ১৫:৫৪ | অনলাইন সংস্করণ

  আরিফুর রহমান

# ঘুষের বিনিময়ে বদলি
# ‘২২ আঙ্গুল’ হিসেবে সবাই চিনেন
# উৎকোচের বিনিময়ে প্রভাব বিস্তার
# টাকার বিনিময়ে প্রায় ১০০ জনকে চাকরির অভিযোগ

জীবন শুরু রাজনীতি দিয়ে। পরে জীবিকার তাগিদে যোগ দেন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে। আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে থাকে নিজের ভাগ্যের চাকা। পিছনের দিকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। হ্যাঁ বলছি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তা তাহের মোল্লার কথা। তিনি বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধান সহকারী হিসেবে কর্মরত আছেন। 

সম্প্রতি, তাহের মোল্লার বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ লিখিত অভিযোগ দেন বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সদস্য মো. মোস্তফা কামাল। 

লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, মন্নাফ মোল্লার দ্বিতীয় পক্ষের চতুর্থ পুত্র আবু তাহের মোল্লা। তিনি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিক ‘সিসিটি’ হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ‘জিওবি ইউনিসেফ প্রকল্পে’। প্রকল্পের জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি হলে তিনি আবেদন করেন উচ্চমান সহকারী/প্রধান সহকারী পদে। অতিরিক্ত বয়সজনিত কারণে এবং নিয়োগ পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ হওয়ায় তার নাম অপেক্ষমাণ তালিকার ১৫নং সিরিয়ালে উঠে আসে। তিনি (তাহের মোল্লা) মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে প্রভাব বিস্তার করে ২০০৪ সালের ৬ জুন উচ্চমান সহকারী পদে যোগদান করেন। প্রকল্প রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের সময় উচ্চমান সহকারী থেকে বনে যান প্রধান সহকারী। অপেক্ষমাণ তালিকা হতে ৪ বছর পর অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত তাহের ঘুষের বিনিময়ে ঢাকা সার্কেলে প্রধান সহকারী পদে বদলি হয়ে আসেন। প্রধান কার্যালয়ে যোগদান করেই শুরু করেন টাকার বিনিময়ে বদলি বাণিজ্য। 

অভিযোগ সূত্রে আরো জানা গেছে, তিনি (তাহের মোল্লা) দপ্তরের কর্মচারীদের সকালে বদলি করে, বিকালে বাতিল করে, হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাহের মোল্লাকে ‘২২ আঙ্গুল’ হিসেবে সবাই চিনেন। নিয়োগ বাণিজ্য প্রায় ১৫ জন আত্মীয় স্বজন ১. রাশেদুল (শালা), নলকূপ মেকানিক, ২. আর দুই মেকানিক (ভাগ্নি) কালীগঞ্জ উপজেলা, ৩. সানজিদা আক্তার, মেকানিক, সদর উপজেলা, গাজীপুর, জেলা অফিসসহ, নরসিংদীসহ অজানা আরও অনেককে টাকার বিনিময়ে প্রায় ১০০ জনকে চাকরি দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। আর এসব উৎকোচের টাকা দিয়ে ৩ কোটি টাকায় মিরপুর-১০ এ বেনারশি পল্লীতে ৫ কাঠা জায়গাসহ একতলা বাড়ি, পূর্বাচলে ৩ কাঠার ২টি প্লট কিনেছেন। 

জানা গেছে, ছাত্রজীবনে জাতীয় পার্টির তাহের মোল্লা অর্থ-বিত্তের কারণে অধিদপ্তরের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন জাতীয় শ্রমিক লীগের সহ-সম্পাদক পদ ছেড়ে কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদ লুফে নেন। মুজিব কোট পরে হয়ে যান ‘আওয়ামী লীগার’ কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনো প্রোগ্রামে তিনি যান না; বা দলীয় কোনো প্রোগ্রামে তার উপস্থিতি কখনও দেখা যায়নি।  

সম্প্রতি, প্রতিষ্ঠানটিতে সাবেক নিয়োগ কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান শামছুল হক ভূইয়াকে টাকা দিয়ে এসব নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। ক্ষিপ্ত হয়ে অধিদপ্তরের সকল সংগঠন এবং সাবেক চেয়ারম্যানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। এ নিয়ে বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচর হলে তাকে উক্ত পদ হতে অব্যাহতি দেন। আরো জানা গেছে, ‘২২ আঙ্গুল’ তাহের মোল্লার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ঢাকা সার্কেলের কর্মচারীগণ প্রধান সহকারী বরাবর অভিযোগ করে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে চতুর তাহেরকে পরিকল্পনা সার্কেল, ঢাকায় বদলি করে দেন। বদলির পর তা বাতিলের জন্য একজন মন্ত্রীকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দেন। মন্ত্রী ফোন করলে সাবেক প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘তিনি  ঢাকায়  আছেন। 

পূর্ত কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সরোয়ার হোসেন তাকে (তাহের মোল্লাকে) পূর্ত কার্যালয়ে নিতে অস্বীকার করে। অনেক লবিং করে দীর্ঘ ২ মাস পর তিনি (তাহের মোল্লা) তার দায়িত্ব বুঝে পান। দায়িত্ব বুঝে পেয়ে আবারো বেপরোয়া হয়ে যান বদলি বাণিজ্য নিয়ে। 

বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী দায়িত্ব বুঝে নিয়ে বিবৃতি দেন আমি ‘চেইন অব কমান্ড’ ফিরিয়ে দিব কিন্তু তাহের এর প্ররোচনায় পড়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে দায়িত্বের কার্যাবলী অনুযায়ী সে বদলি নির্বাহী প্রকৌশলী (এক জেলার মধ্যে এক উপজেলা হতে অন্য উপজেলায়) করতে পারেন তা সরোয়ার হোসেনকে দিয়ে করে একদিকে তাকে বিতর্কের মধ্যে ফেলে জিম্মি করছেন, অন্যদিকে কর্মচারীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কক্সবাজার জেলায় এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। 

কর্তৃপক্ষের সুপারিশ না থাকলেও তিনি সাদা কাগজে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দোষী প্রমাণিত মেকানিককে ৬ মাস না যেতেই আবার বড় ধরনের অর্থের বিনিময়ে পূর্বে তাদের ইতিহাস গোপন করে বদলি করেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে মেকানিক বদলি এক লাখ টাকা এবং টাঙ্গাইলে একজন জুনিয়র প্রায় ১ বছর হতে ২ বছর চাকরি হয়েছে তার কাছ থেকে প্রায় ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে অব্যাহতি প্রাপ্ত সাবেক নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, ঢাকা সার্কেলকে দিয়ে ‘ক্লার্ক-কাম-টাইপিস্ট’ হতে ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব দেন। এমনকি তার এখনও স্থায়ীকরণ পর্যন্ত হয়নি। 

বিধি মোতাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ত) এ দায়িত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। অথচ শামসুল হক ভূইয়া অবসরে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে এ নিয়ম বহির্ভূতভাবে এ দায়িত্ব দেন। আর এ শামসুল হক এর আস্থাভাজন হয়ে তাহের এবং তার অনুসারীরা নিয়োগ বাণিজ্য করতেন। তদন্ত কমিটি করলে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ বের হবে বলে অধিদপ্তরের এক নেতা বলেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের  বিভিন্ন সংগঠনের নেতা এবং কর্মচারিরা এ প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকা সার্কেলের প্রধান সহকারী থাকাকালীন সময়ে নিজ অফিসের মহিলা অফিস পিয়নকে বদিলসহ প্রতি সপ্তাহে বদলি করে আবার বদলি বাতিল করে এত পরিমাণ ঘুষ গ্রহণ করেছেন যা ইতিহাসে বিরল অথচ ‘২২ আঙ্গুলই’ তাহের ধরাছোঁয়ার বাইরে। নরসিংদীর এক বিপদগ্রস্ত কর্মচারীর কাছ থেকে বদলির কথা বলে টাকা নিয়ে প্রায় ৪ বছর হচ্ছে এখনও বদলি করাননি আবার ফেরতও দেননি।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তার অপেক্ষমাণ তালিকা হতে নিয়োগ পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে তার চাকরি চলে যাবে তাই না করাই ভাল। কারণ তার পরিবার আছে তবে তিনি যে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে কর্মকর্তাদের বিপাকে ফেলেন তা তিনি স্বীকার করেন।’

এই বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান সহকারী তাহের মোল্লার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

এবি/ জিয়া