মৃতপ্রায় ২০ দলীয় জোট

প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩, ১৭:১৫ | অনলাইন সংস্করণ

  রতন বালো

  প্রিন্ট ভার্সন

ছবি: আমার বার্তা প্রির্ট ভার্সন

মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে ২০ দলীয় জোটের সাংগঠনিক কার্যক্রম। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জোট নিয়ে ভাবছে না কেউ। একলা চলো নীতিতে চলছে বিএনপি। জোটের মধ্যে নিবন্ধিত দলমাত্র ছয়টি, বাকি ১৪টি অনিবন্ধিত। অধিকাংশ দল চলছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সব মিলিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের কোনো অস্তিত্বই নেই।

শুধু নামেই চলছে দেশের বড় এ জোট। আন্দোলন-সংগ্রাম কিংবা মাঠের রাজনীতিতে তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দেখা যায় না। যে যার মতো চলছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনেও অংশ নেয়নি তারা।

মতবিরোধের কারণে বিএনপির প্রার্থীদের সঙ্গেও ভোটের মাঠে ছিলেন না শরিক দলের নেতারা। আন্দোলন-সংগ্রামেও রাজপথে এখন আর নেই। করোনা মহামারী সময়ের পর থেকে নেই জোটবদ্ধ কার্যক্রম। সাধারণ মানুষের পাশেও নেই জোটভিত্তিক এসব রাজনৈতিক দল। 

রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিও এখন অনেকটাই ‘একলা চলো নীতি’-তে চলছে। অধ্যাপক ডা.বদরুদ্দোজার নেতৃত্বে বিকল্পধারা বাংলাদেশ, প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে ছিলো বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট এলায়েন্সসহ (বিএনএ) ছোট ছোট জোটগুলো এখন অস্তিত্বসংকটে পড়েছে।

এর মধ্যে বামপন্থি রাজনৈতিক আদর্শের পতাকাবাহী আটটি রাজনৈতিক দলের জোট ‘গণতান্ত্রিক বাম জোট’ রাজপথে কিছুটা সক্রিয়। এ ছাড়া অন্যান্য ছোট দলগুলো এখন বিলীনের পথে। আসন ভাগাভাগি নিয়ে প্রধান এই দলের কাছে শরিক দলগুলো ‘অস্বাভাবিক’ আবদারও করেছিল।

যদিও শেষ পর্যন্ত গুটি কয়েক আসন নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। ভোটের পর থেকেই জোটবদ্ধ দলগুলোর নেই তেমন কোনো কার্যক্রম। 

২০২১ সালের ১৪ জুলাই ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক প্রাচীন ধর্মীয় সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ( জমিয়ত)। পুরানা পল্টনে সংগঠনটির জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন জমিয়তের সে সময়ের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া। ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি বিএনপির অনাস্থা ও জোটের শরিক দল হিসেবে যথাযথ মূল্যায়ন না করাসহ কয়েকটি অভিযোগ করেন সে সময় জমিয়ত ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। 

মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া বলেন, ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করা জমিয়তের জন্য কল্যাণকর। আজ  থেকে জোটের কোনও কার্যক্রমে জমিয়ত থাকবে না। কারণ হিসেবে তিনি সে সময় বলেছেন, জোটের শরিক দলের যথাযথ মূল্যায়ন না করা, শরিকদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই উপনির্বাচন এককভাবে বর্জন করা, আলমদের গ্রেফতারের প্রতিবাদ না করা, প্রয়াত জমিয়ত মহাসচিব নূর হোসেন কাসেমীর মৃত্যুতে বিএনপির পক্ষ থেকে সমবেদনা না জানানো এবং তার জানাজায় শরিক না হওয়া।
২০ দলীয় জোট সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোটে থাকা জামায়াতে ইসলামী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, লেবার পার্টি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ইস্যুভিত্তিক কিছু কর্মসূচি পালন করলেও বাকি দলের কোনো তৎপরতা নেই বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, অধিকাংশ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পর্যন্ত নেই। কেন্দ্রীয় কমিটি থাকলেও নেই জেলা কমিটি। কয়েকটি আবার এক ব্যক্তির এক দল নামেও পরিচিত। 

গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০ দলীয় জোটে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে এ কথা স্বীকার করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, জোট নিয়ে এখন আমাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। এমনকি স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকেও এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা এখন দল (বিএনপি) নিয়ে কাজ করছি। নিজেদের দল গোছাচ্ছি।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বছরে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের দু-একটি বৈঠক ছাড়া আর কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম নেই এই জোটের। তাও গত দুই বছরে কোনো বৈঠকে জোটের শীর্ষ বা মহাসচিব পর্যায়ের কোনো নেতাকে দেখা যায়নি।

জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান মাঝেমধ্যে তাদের নিয়ে একটু আধটু চা-চক্রের আয়োজন করেন। এর মধ্যেই কিছুদিন আগে জোট ছেড়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী বাংলাদেশ। তারও আগে বিদায় নিয়েছে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমানের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। ইসলামী ঐক্যজোট, বিকল্প ধারা, এনপিপিসহ আরও কয়েকটি সংগঠন এর আগে ২০ দল ছেড়ে গেলেও একই নামে খন্ডিত বা আংশিকভাবে সংগঠনগুলো নামেমাত্র ধরে রাখা হয়েছে এই জোটে। 

২০ দলের অন্যতম শরিক দল এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছেন, জোটের এখন কোনো কার্যক্রম নেই। বিভিন্ন কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে কিছু সমস্যা রয়েছে। ফলে ২০ দলীয় ঐক্যজোট সক্রিয় হচ্ছে না। বিএনপি হলো একটি সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। তারা একটি আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে ২০ দলীয় জোট গঠন করেছিল।
এখানে অনেকগুলো দল আছে যাদের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। কতদূর তাদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে, কতদূর সফলতা আসবে এটা বলা খুব কঠিন। অলি আহমদ মনে করেন, চালকের আসনে থাকা বিএনপিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। 
আরেক শরিক লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, জোটের ভেতরে বেশ কিছু দল আছে যাদের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল, নেতৃত্বের অবস্থা খুবই খারাপ। সৃষ্টি হয়েছে চরম হতাশা। যোগাযোগই বন্ধ করে দিচ্ছে একে অপরের সঙ্গে। সবচেয়ে বেশি তুঙ্গে জামায়াত-বিএনপির টানাপোড়েন।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা জানান,  গত ২০২১ সালের জুলাইয়ে সর্বশেষ ২০-দলীয় জোটের একবার ভার্চুয়াল বৈঠক হয়। বিএনপি এই জোটের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী দল। তাদেরই জোট চাঙা করার ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন বা জোটগত রাজনীতি চালু রাখার ক্ষেত্রেও বিএনপিকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

উল্লেখ, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটকে সঙ্গে নিয়ে ‘চারদলীয় জোট’ গঠন করেছিল বিএনপি। পরে এইচএম এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বেরিয়ে গেলে নাজিউর রহমান মঞ্জুর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) জোটে থেকে যায়।

২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোট কলেবরে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ দলীয় জোটে। এরপর পরিধি দাঁড়ায় ২০ দলে। তবে ২০ দলীয় জোট থেকে ইসলামী ঐক্যজোট, এনপিপি, ন্যাপ ও এনডিপির একাংশ বেরিয়ে যায়। আন্দালিব রহমান পার্থর দল বিজেপিও বেরিয়ে যায় জোট থেকে।

এবি/ওজি