ডিজিটাল ইকোনমিতে তরুণদের অংশগ্রহণে বাড়ছে প্রবৃদ্ধির গতি

প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:৩০ | অনলাইন সংস্করণ

  সাকিফ শামীম:

গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক অবিশ্বাস্য রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং সামাজিক সূচকগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন—এসবই বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই অগ্রযাত্রার নেপথ্যে রয়েছে এক নিরবচ্ছিন্ন শক্তি: দেশের বিশাল যুবগোষ্ঠী। গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ছিল চোখে পড়ার মতো, যার পেছনে অন্যতম মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ডিজিটাল ইকোনমিতে তরুণদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। কর্মসংস্থানের খোঁজে নিজেদের আটকে না রেখে, নিজেরাই সৃষ্টি করছে নতুন অর্থনৈতিক বাস্তুতন্ত্র (ecosystem)। 

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি এবং ডলার সংকটের মতো চ্যালেঞ্জগুলো যখন আমাদের সামনে উপস্থিত, তখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো যেন এক ভিন্ন পথ দেখাচ্ছে। আউটসোর্সিং, ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের মাধ্যমে তরুণ উদ্যোক্তারা দেশের ভেতরে ও বাইরে নতুন নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করছেন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (BASIS)-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশের আইটি ও আইটি-এনাবলড সার্ভিসেস (ITES) খাত থেকে বার্ষিক রপ্তানি আয় প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার, যার একটি বড় অংশ আসে তরুণ ফ্রিল্যান্সার ও উদ্যোক্তাদের হাত ধরে। এই সংখ্যা চলতি বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং জগতে অন্যতম শীর্ষস্থানে রয়েছে। গ্লোবাল ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্ম আপওয়ার্ক (Upwork)-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। প্রতি বছর হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে যুক্ত হচ্ছে এবং বিদেশি ক্লায়েন্টদের থেকে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।  এই অর্জন সম্ভব হয়েছে মূলত তরুণ প্রজন্মের প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী মানসিকতার কারণে। 

ই-কমার্স খাতও তরুণদের অংশগ্রহণে অভাবনীয় গতি লাভ করেছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (BASIS)-এর তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ২৫,০০০ এরও বেশি ই-কমার্স সাইট এবং ফেসবুক-ভিত্তিক এফ-কমার্স পেজ রয়েছে, যার অধিকাংশই পরিচালনা করছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে যখন প্রচলিত ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছিল, তখন এই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোই অর্থনীতিকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসারে আইটি পার্কের বাস্তবায়ন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ইতোমধ্যে কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্কসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৩৯টি হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এবং আইটি ইনকিউবেশন সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলোর মূল লক্ষ্য হলো উন্নত আইটি অবকাঠামো প্রদান করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সহায়ক ইকোসিস্টেম তৈরি করা।

তবে, এই পার্কগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে কিছু প্রশ্নও রয়েছে। যেমন, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং এর ব্যবহারকে আরও সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সৌরশক্তি ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার করে আইটি পার্কগুলোকে আরও টেকসই করা সম্ভব। এছাড়া, বিদ্যুৎ সংযোগের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত না হলে সেখানে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো তাদের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবে না, যা পুরো প্রকল্পের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করবে।

ডিজিটাল অর্থনীতির গতি বাড়াতে সরকারের নীতি সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আইটি পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক কমানো একটি জরুরি পদক্ষেপ। এটি আমাদের স্থানীয় আইটি কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি আমদানি করতে সাহায্য করবে, যা তাদের উৎপাদন ক্ষমতা এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াবে। এছাড়া, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ, কর ছাড় এবং সহজ ব্যবসায়িক নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

দক্ষতা উন্নয়ন (Skill Building and Development) ডিজিটাল বিপ্লবের মূল ভিত্তি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন তা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদা পূরণ করতে পারে। কোডিং, ডেটা সায়েন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং সাইবার সিকিউরিটির মতো বিষয়গুলোতে তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়া অপরিহার্য। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এবং স্টার্টআপ বাংলাদেশ-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা (Entrepreneurs' Policies) প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। এই নীতিমালায় স্টার্টআপদের জন্য সহজ ঋণ প্রাপ্তি, ভেনচার ক্যাপিটাল ফান্ডিং-এর সুবিধা, এবং ট্যাক্স হলিডে-এর মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

একই সাথে, কৌশলগত পেটেন্ট উন্নয়ন (Strategic Patent Development) ডিজিটাল অর্থনীতির সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। আমাদের উদ্ভাবন ও মেধা সম্পদকে সুরক্ষিত রাখতে শক্তিশালী পেটেন্ট আইনের বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এটি শুধু আমাদের উদ্ভাবকদের উৎসাহিতই করবে না, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও মজবুত করবে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন অধ্যায় রচিত হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে। ডিজিটাল ইকোনমিতে তাদের অংশগ্রহণ এক নতুন আশার সঞ্চার করেছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, বরং এক অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই সমাজ গঠনেও সাহায্য করছে। সামনে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে সঠিক নীতি ও কার্যকর বাস্তবায়ন আমাদের এই পথচলাকে আরও মসৃণ করতে পারে। তরুণদের অদম্য শক্তি ও উদ্ভাবনী মেধার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশ অচিরেই বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ডিজিটাল অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।


লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ।

আমার বার্তা/সাকিফ শামীম/এমই