প্রতিবন্ধকতাকে না বলি

প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:৩১ | অনলাইন সংস্করণ

  রোকাইয়া আক্তার তিথি

সুস্থ স্বাভাবিক কর্মক্ষম ব্যক্তিবর্গের কাছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেনো এক অপায়াময় করুন অবহেলার পাত্র। তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও যেনো জানিয়ে দেয় অনেক অব্যক্ত উক্তি। দূরে ফেলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে তাদের থেকে, সমতালে চলতে সৃষ্টি করে বাঁধা।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কথা বললেই যেনো আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে শারীরিক বা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি, যারা শুধুমাত্র করুণার পাত্র, অবজ্ঞার পাত্র যাদেরকে তথাকথিত সুশীল সমাজ এড়িয়ে চলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু তারা কি সত্যিই অবেহালার উপেক্ষার? শুধু শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ বা কোনো ত্রুটি থাকলেই কি সে প্রতিবন্ধী হিসেবে গণ্য? তাদেরকে সমাজে অবদান রাখার ক্ষমতা একদমই নেই?

সাধারণত কোনো ব্যক্তির দীর্ঘ সময় বা আজীবন কোনো শারীরিক বা মানসিক সমস্যা থাকলে এবং তার জন্যে তার কর্মক্ষেত্রে দৈনিক কাজে বাধার সম্মুখীন হলে তাকে তার প্রতিবন্ধকতা বলা হয় এবং আমরা তাদেরকে প্রতিবন্ধী হিসেবে গণ্য করি। কিন্তু শুধু প্রতিবন্ধী বলেই যে তারা পিছিয়ে থাকবে এমন বিষয় মোটেও কাম্য নয়। উপযুক্ত মাধ্যম করে তুলতে পারে দেশের দক্ষ জনশক্তি রূপে। তীব্র মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয় আজকের আলোচ্য নয়। আজকের আলোচ্য বিষয় আমাদের সমাজ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি তাদের আচরণ। 

আমেরিকান লেখিকা হেলেন কিলার, বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং, গণিতবিদ জন ন্যাশ, মেক্সিকোর কালজয়ী চিত্রশিল্পী ফ্রিডা কোহেল। এইরূপ কিছু কালজয়ী ব্যক্তিদের অবদান সম্পর্কে আমরা নিশ্চয় অবগত, যাঁরা তাদের কর্মগুণে প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছেন। 

কিন্তু, আমাদের গ্রাম-বাংলাসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে এড়িয়ে চলার বিষয়টি লক্ষণীয় ও কষ্টদায়ক। এবং তাদের মধ্যে কিছু বদ্ধমূল কুসংস্কার বিদ্যমান। 

প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তার পরিবারকে সমাজ থেকে আলাদাভাবে গণ্য করা হয়, যেকোনো অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উপস্থিতি যেনো সবার কাছেই একটু বিরক্তিকর। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রেও তাদেরকে অবহেলা সহ্য করতে হয়। ফলস্বরূপ ব্যক্তিটি হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকে, তার মধ্যে ইচ্ছাশক্তি দমায়িত করা হয়, দায়ী সুশীল সমাজ এর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যারা তাদেরকে হেয় করার জন্য চেয়ে থাকে। 

কিন্তু এই সকল ব্যক্তি একটু সাহায্য, একটু সহযোগিতা পেলে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। তার জন্য প্রয়োজন তাদেরকে উৎসাহিত করা ও যথাসাধ্য সহায়তা করা। তাদেরকে করুনা করার কোনো প্রয়োজন নেই, তারাও স্বাভাবিক ব্যক্তির মতোই তাদের প্রতিবন্ধকতাকে তারা গুরুত্ব না দিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে তাদের ওই প্রতিবন্ধকতা কি আর সত্যই বিচরণ করে? আবার অনেক সুস্থ স্বাভাবিক ব্যক্তি আছেন যারা নিজেদের মধ্যে কৃত্রিম বাঁধা নিজেরাই সৃষ্টি করে প্রতিবন্ধকতার আবির্ভাব ঘটান। 

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদা অন্যরকম। একটি ঘটনা বলা যাক। সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়ে তাহেরা বয়স পনেরো বছর মানসিক ও বাকপ্রতিবন্ধী। বাবা মায়ের কাছে থাকার সুযোগ নেই। ঠায় মিলেছে দাদা দাদির ঘরে। পরম যত্নে লালন করছেন তার দাদি নূরজাহান। প্রতিটি কাজই তাকে করে দিতে হয়। যোহরের আযানের সাথে সাথেই লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। আযানের ধ্বনি শুনলেই তার এই অবস্থা। নূরজাহানের মতে, ‘আযান হইলেই কান্না করে, জন্মের পর থেকেই এই অবস্থা।’ চিকিৎসা করা হয়নি যথার্থ, প্রতিবন্ধকতাকে যেনো অভিশাপ হিসেবেই গণ্য করেছেন তারা। কোথায় যেতে পারেন না তাহেরাকে রেখে। চেষ্টা করেন লোক চক্ষুর অন্তরালে রাখার।

এইরূপ অগণিত ঘটনা ঘটে চলেছে আমাদের চারিদিকে, যেখানে প্রতিবন্ধকতার জন্য নেওয়া হয় না কোনো চিকিৎসা, তারা যেনো সর্বদায় অভিশপ্ত, অবজ্ঞার পাত্র, লুকায়িত রাখায় যেনো শ্রেয়, প্রিয়জনরাও আর প্রিয় থাকে না। 

মুদ্রার এপিঠ যেমন থাকে তেমনি রয়েছে ওপিঠও। স্বপ্না রাজবংশী সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী ( জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)। ২৬ বছরের জীবনে মায়ের সহযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দমিয়ে রাখতে পারেনি তার অদম্য ইচ্ছেশক্তিকে। অবদান রাখছেন তার বিভিন্ন কর্মগুণে। সমাজ তার সর্বদা অনুকূলে ছিলো না। ক্ষেত্র বিশেষে সহ্য করেছেন বিভিন্ন কটাক্ষ। পরিবারের সহায়তা ও তার প্রবল ইচ্ছাশক্তিই যেনো মূল আঁধার। 

আমাদের উচিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে আলাদা করে না দেখে সমসারির ব্যক্তি হিসেবে দেখা। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যেনো তারা তাদেরকে প্রস্ফুটিত করতে পারে। আমাদের চিন্তাভাবনা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা জরুরি। যেনো তারা নিজেদেরকে গুটিয়ে না ফেলে। নয়ত আমরাও তাদের হীনমন্যতার জন্য সম দোষে দোষী।

লেখক: শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

এবি/ জিয়া