বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪, ১৫:১২ | অনলাইন সংস্করণ
ড. খান আসাদুজ্জামান:

সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মহান মন্ত্রের উচ্চারণে বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, সে অধ্যায়ের নাম বাংলাদেশ। এই অধ্যায় লেখা হয়েছে ৯ মাসব্যাপী অকুতোভয় বীরের রক্ত কালিতে, আমাদের ভাই হারানো ব্যাথা আর মা বোনের অমূল্য সম্ভ্রমের মূল্যে। যে অধ্যায়ের রচয়িতা একজন অদ্বিতীয় জনমানুষের কবি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি, মহাকালের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের এ তারিখে পদ্মা-মেঘনা-যমুনাবিধৌত এতদঅঞ্চলের মানুষ একটি ভাষণ শুনেছিল। যে মানুষটি ১৯৪৮ থেকে শুরু করে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়ে ধাপে ধাপে সেই মহাজাগরণের ডাকটি দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন ইতিহাসের সমান্তরালে আর দেশের মানুষকে প্রস্তুত করেছেন, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এক মহাজাগরণে শামিল হয়ে ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সময় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে; তিনিই হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উদ্বেলিত মহাসমাবেশে বলিষ্ঠ কণ্ঠে যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। বঙ্গবন্ধুর সেই তেজোদীপ্ত উচ্চারণ-"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"। শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, সেই ভাষণ আজও বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করে, অনুপ্রাণিত করে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিশলাকা, যা প্রজ্বালিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই দাবানলের, যার সামনে টিকতে পারেনি শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশিয় সহযোগীরা। ১৯৭১-এর ৭ থেকে ২৫ মার্চ, এ ১৮ দিনে এ ভাষণ বাংলাদেশেরে সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
বঙ্গবন্ধু বাংলাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এবং ক্ষুধামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ার। তিনি এক সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে তিনি তৈরি করবেন দক্ষ মানবসম্পদ আর যারা হবে নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান, সুশিক্ষিত নাগরিক। একটি সামাজিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে নিউজ উইক ম্যাগাজিন ওদের একটি কভার স্টোরিতে বঙ্গবন্ধুকে 'রাজনীতির কবি' বলে আখ্যায়িত করে।
বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই ঠিক করেছিলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্সে ভাষণ দেবেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার ঢল নামে। সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়। সেই দিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে জেগে উঠেছিল পুরো জাতি। ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের, যেদিন তিনি দেন সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। তাতে ছিল নির্দেশনা আর সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির কথা। এটি ছিল একটি এপিক ভাষণ; এ ভাষণের মধ্য দিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করলেন তিনি। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তাই তো বাংলার দামাল ছেলেরা ৯ মাস যুদ্ধ করার মনোবল পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এ তেজোদীপ্ত মুক্তির বাণী শোনার জন্য ওইদিন সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ দলে দলে হেঁটে, বাস-ট্রাক-লঞ্চ-ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারী-পুরুষের স্রোতে সয়লাব হয়ে যায় তখনকার ঘোড়দৌড়ের এ বিশাল ময়দান।
এ ভাষণের ব্যঞ্জনা, তাৎপর্য ও গুরুত্ব সেদিন যারা কাছে বসে শুনেছেন, তারাই বুঝতে পারবেন। সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক করতে এ ভাষণের কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি যথার্থই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত ঘোষণা-"সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না" সত্য হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এ ভাষণের সুর অনুসরণ করেই এক নতুন রেনেসাঁর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ দিনটি ছিলো রবিবার, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান ছিলো কয়েক লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ, দুপুর ২.৪৫ মিনিটে বক্তব্য শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একমাত্র বক্তা হিসেবে তিনি প্রায় ১৮ মিনিট বক্তব্য প্রদান করেন । সেদিন তিনি লিখিত কোনো বক্তব্য দেননি, জাতীয় পর্যায়ের আওয়ামীলীগ ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে পূর্ব আলোচনার মাধ্যমে কিছু কিছু বিষয় নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তিনি। তার সে ভাষণের অন্যতম অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন তার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে রওনা হন তখন বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন "তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে"
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ১৮ মিনিটের বক্তব্যে স্বাধীনতা এবং প্রয়োজনে সংগ্রাম-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু অত্যন্ত সুনিপুণ ও কৌশলগতভাবে তুলে ধরেন বাঙালির জন্য৷ এমন কৌশলে পাকিস্তানিরা হতবাক হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক সে ভাষণে উপস্থিত জনতাকে "ভাইয়েরা আমার; আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি" বলে তাঁর ভাষণ শুরু করেছিলেন । তারপর একাধারে তিনি সে সময়ের বিভিন্ন স্থানে চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন, তিনি বাংলার মানুষের প্রত্যাশার আয়না হয়ে তুলে ধরেন " আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়", "এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে" একই সাথে তিনি ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮-এর মার্শাল ল', ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনাবলীরসহ ২৩ বছরের নির্যাতন, নিপীড়নের দৃশ্য তুলে ধরেন।
২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবরে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে "ডকুমেন্টারি হেরিটেজ" (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে। 'মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ)' ৭ই মার্চের ভাষণসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে। ১৩টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়। সঠিক নির্দেশনা এবং জনগন বা কর্মী বান্ধব ভাষণ নেতৃত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গুন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বগুনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ৭ই মার্চের ভাষণ যা বর্তমান সময়কার রাজনীতিবীদ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত শিক্ষনীয় একটি বিষয়। এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি একই সাথে তৎকালীন পরিস্থিতি, বাঙালির ইতিহাস, পাকিস্তানিদের অত্যাচার নিপীড়ন, পাকিস্তানিদের অনৈতিক কার্যকলাপ, বাঙালির চাওয়া পাওয়া, জনগণকে উজ্জীবিত করা, নিজের শক্তি সামর্থ্য তৈরিতে নির্দেশনাসহ সময়োপযোগী বিষয়বস্তুগুলো অত্যন্ত শৃঙ্খলভাবে মার্জিত ভাষায় তুলে ধরেছিলেন, যা ছিলো সকলের জন্য সহজ ও বোধগম্য। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনলে আজও হৃদয়ে কম্পন তৈরি হয় প্রতিটি বাঙালির।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি, মহাকালের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শিশুকাল, ছাত্রজীবন, রাজনৈতিক জীবনের উত্তাল সংগ্রামী তরঙ্গমালা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, জেল-জীবন, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ত্যাগ ও অন্তহীন প্রেরণা, শিশু রাসেলের শেষ আকুতি ‘‘আমি মায়ের কাছে যাবো’’, ছয়দফা, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত, চুড়ান্ত বিজয় অর্জন তথা সর্বোপরি তাঁর স্বর্ণোজ্জ্বল নেতৃত্ব প্রদানের সময়ের শ্বেত-সোপানের আলোকে আমি রচনা করেছি ‘ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের মহাকাব্য’ কাব্যগ্রন্থ । গ্রন্থটি বিষয়ভিত্তিক, গবেষণামূলক, তথ্যবহুল ও ব্যতিক্রমধর্মী কাব্যপ্রয়াস। কথাসাহিত্য বা জীবনালেখ্য রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবনীর উপর ইতঃপূর্বে বহু গ্রন্থ রচিত হলেও একজন কবির রচনায় কবিতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়সমূহ অত্যন্ত মৌলিকতায় একই গ্রন্থে কবিতা, গান ও আলোকচিত্রের সমন্বয়ে চিত্রায়িত করার এই অনন্য প্রয়াস সম্ভবত বাংলাদেশে এটিই প্রথম। এখানে রয়েছে মোট ৬১টি কবিতা, তারমধ্যে ১১টি কবিতা গান হিসেবে উপস্থাপন করেছি। ৭ই মার্চের অগ্নিগর্ভ ভাষণে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন জনতার কণ্ঠস্বরে। একটি ঘুমন্ত জাতিকে তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার করা, তাদের সকল শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে শেখানো, দীর্ঘ কন্টকাকীর্ণ সাধনায় সমগ্র বাঙালি জাতির মনে সঞ্চার করেছিলেন স্বাধীনতার বাসনা। তাই এই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে মূল উপজীব্য বিষয় ধরে এই গ্রন্থের নামকরণ করি 'ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের মহাকাব্য' এবং এই গ্রন্থের প্রথম কবিতার নামও 'ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের মহাকাব্য'।
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যেমন হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো সমগ্র জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করেছিলেন। পৃথিবীতে কোনো ব্যক্তির একক স্বাধীনতার ঘোষণা এতটা আলোড়ন তুলতে পারেনি যা পেরেছিলো বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। এই ঘোষণা কোটি মানুষকে মরণপণ সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছিলো যা অজেয় শক্তি হয়ে আমাদের জন্য ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে স্বাধীনতাকে। তাই 'ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের মহাকাব্য' কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হিসেবে তুলে ধরেছি,
সেদিনের সেই বাঁশরীর সুর
যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা তুমি
উন্মুখ বাঙালির স্রোতধারা এসে মিশেছিলো
বাংলার সকল চত্বরে চত্বরে
রেসকোর্স, পল্টনে
ইস্টিশনে ইস্টিশনে।
এছাড়াও এ কাব্যগ্রন্থের 'বঙ্গবন্ধু নিখাদ বাঙালি' কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে হ্যামিলনের বাঁশির সুরের সাথে তুলনা করেছি,
তুমি ছিলে মহাবিপ্লব
পরিবর্তনের এক ঝড়ো হাওয়া
ছিলে বাংলার বুকে আলোড়িত
তুমি হেমিলনের বাঁশির সুর।
লেখক : কবি, লেখক, গবেষক, সম্পাদক, গীতিকার, সুরকার, কন্ঠশিল্পী (বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন) এবং আইনবিদ। নির্বাহী পরিচালক, সোসাইটি ফর এনলাইটেনিং নেশন (SOFEN)