নৌপরিবহন অধিদপ্তরে নিজের অপরাধ দেখবেন মহাপরিচালক!

প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৩, ২০:১০ | অনলাইন সংস্করণ

  আরিফুর রহমান

# কাজ না করে প্রকল্পের টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি
# অনিয়ম করে সাবেক মহাপরিচালক চলে গেল নিজ দপ্তরে
# ঘুষের টাকা বর্ণনার আলোচনা রয়েছে মন্ত্রণালয়ে 

নৌপরিবহন অধিদপ্তর একটি সেবামূলক সংস্থা। এখন এই প্রতিষ্ঠানটিতে যারাই কর্মরত আছেন। কোনো না কোনোভাবে ‘লুটপাট’ করে নিজেকে ‘সাধু’ বানোনোর চেষ্টায় আছে। দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও কথা বলতে নারাজ অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের সবার মুখে এখন একই সুর নতুন মহাপরিচালক ‘স্যার’ আসছে। 

সম্প্রতি, ‘লাইটহাউজ প্রকল্প’ নামে পরিচিত নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এজন্য নৌ-পরিবহন ডিজি কমডোর নিজামুল হককে মহাপরিচালকের পদ থেকে প্রত্যাহার করে নৌ বাহিনীতে ফেরত পাঠিয়েছে সরকার। তার স্থলে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়েছে নৌবাহিনীতে কর্মরত কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলমকে। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেন। 

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উপকূল এলাকা থেকে গভীর সাগরের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নজরদারির আওতায় আনার লক্ষ্যে সাতটি লাইটহাউজ ও সাতটি কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় একটি ১১ তলা ভবন নির্মাণও রয়েছে। প্রকল্পটির সর্বশেষ বর্ধিত ব্যয় ৭৭৯ কোটি টাকা। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের পর নৌ-মন্ত্রণালয় কমডোর নিজামকে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদ থেকে প্রত্যাহারের প্রস্তাব করে। এরপর তাকে প্রত্যাহারের প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে সরকার। 

তবে তদন্ত প্রতিবেদনে দায়ী অন্যদের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ডিপিডি, এপিডি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে সরাসরি কোনো সুপারিশ করা হয়নি। কারিগরি কমিটি গঠন করে এই কমিটির মাধ্যমে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দায়-দায়িত্ব যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, তদন্তকালে বিভিন্নজনের মৌখিক (অনানুষ্ঠানিক) জবানিতে ‘ডিপিডি’ ও ‘এপিডিদের’ বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কাজ না করে বিল পরিশোধের নামে প্রকল্পের টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া কমডোর এ জেড এম জালালউদ্দিন নৌ অধিদপ্তরের ডিজি থাকাকালে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে আরও বিস্ময়কর তথ্য উঠে আসে। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কোন কাজে কে কতো টাকা ঘুষ দিয়েছেন, তার বর্ণনা রয়েছে। ঘুষ বাবদ টাকা লেনদেনের এ ভয়ঙ্কর বক্তব্য ওই বৈঠকের কার্যবিবরণীতেও স্থান পেয়েছে। তবুও প্রকল্পের এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ কারণে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। 

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সহ-ঠিকাদার নিয়োগ, বেআইনিভাবে দরপত্র প্রক্রিয়াকরণ ও ভীতি প্রদর্শনসহ সাতটি অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার বণিকের নেতৃত্বে চলতি বছরে (২৬ এপ্রিল) পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সম্প্রতি নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে আটটি সুপারিশসহ ৪২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। তবে মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেছে। বহুল আলোচিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। এটি বাস্তবায়নের সর্বশেষ বর্ধিত সময়সীমা ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। 

জানা গেছে, ব্যাপক সমালোচিত ডিজি নৌবাহিনীতে চলে যাওয়ার পর এখন তারই কিছু সহযোগীর নাম উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিতে সহকারী কেমিস্ট হিসেবে কর্মরত আছেন ফাওজিয়া রহমান। আরেকজন হচ্ছেন ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ। তিনি নৌপরিবহন অধিদপ্তরে চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (চলতি দায়িত্ব) পালন করছেন।

ফাওজিয়া রহমান : তিনি (ফাওজিয়া রহমান) ঘুষ ছাড়া কোনো ‘ফাইল ওয়ার্ক’ করেন না। এছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দপ্তরে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিজের দখলে নিয়ে ইচ্ছেমত ‘নোট লিখে’ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেন। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে ‘দহরম মহরম’ সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের ‘ফাইল ওয়ার্কে’ও হস্তক্ষেপ করেন। তার কাছে কোনো ফাইল গেলে সেটি তিনি ফটোকপি করে অথবা মোবাইলে ছবি তুলে রেখে সেগুলো বাইরে পাবলিক, নৌযান মালিক, এজেন্ট বা কোম্পানির কাছে পাচার করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া দীর্ঘ ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান করলেও তার কোনো বদলি হয়না। সে কারণে তিনি সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে নিজের স্বার্থ হাসিল করে থাকেন। তার অত্যাচারে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরে কোনো কর্মকর্তাই শান্তিতে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। 

আরো অভিযোগ আছে, এক কর্মকর্তার সাথে আরেক কর্মকর্তার দ্বন্দ্ব এবং কান কথা লাগিয়ে দুই জনের কাছেই   সুবিধা হাসিল করেন তিনি। তার নৈতিক চরিত্র নিয়েও নানা কথা প্রচলিত রয়েছে। 

সম্প্রতিকালেও তিনি (ফাওজিয়া রহমান) নৌপরিবহন অধিদপ্তরের লাইট হাউজ নির্মাণ প্রকল্পের ‘ডিপিপি’ আবু হায়াত আশরাফুল আলমের সাথে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তুলে এক বছর ধরে অবৈধ মেলামেশা করছেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ায় ক্যাপ্টেন আশরাফুলের সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সম্প্রতি নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর জনৈক শাহাদত হোসেন এক ব্যক্তি একটি লিখিত অভিযোগের চিঠি জমা দিয়েছেন ফাওজিয়া রহমান এর বিরুদ্ধে। 

অভিযোগগুলো হলো : ফাওজিয়া রহমানকে দেশের পরিবেশ রক্ষার্থে ও দূষণমুক্ত রাখার স্বার্থে নদীর পানি পরীক্ষা- নিরীক্ষার নিমিত্তে পরিবেশ রক্ষামূলক প্রকল্পকে রেভিনিউ বাজেটে স্থানান্তর করে এই অধিদপ্তরের আওতায় নারায়ণগঞ্জের সরকারি প্রতিষ্ঠিত ল্যাবরেটরিতে নিয়োগ দেয়া সত্ত্বেও তিনি সেখানে যোগদান না করে কোনো এক অজানা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। 
অথচ: প্রধান কার্যালয়ে তার নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। ফলে নদীর পানি দূষণমুক্ত কি না পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুব্যবস্থা থাকলেও সেটি ব্যবহার না করার ফলে কোটি কোটি টাকার সরকারি যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ে আছে। কেমিক্যালগুলোও  মেয়াদোত্তীর্র্র্ণ হয়ে  নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

আরো জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনার ফসল সমুদ্রে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য মেরিন একাডেমিতে প্রশিক্ষিত নারী কর্মকর্তাকে ‘সিডিসি’ প্রদানে বাধা সৃষ্টি করতেও দ্বিধাবোধ করেননি তিনি। তিনি মেরিনারদের ‘সিওপি’ সম্পর্কীয় বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত থেকে অবৈধপথে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ফাওজিয়া রহমান লাইট হাউজ নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিপি আবু হায়াত আশরাফুল আলমের সাথে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলে কোভিড-১৯ সময়ে তার বউয়ের অনুপস্থিতিতে বৌদ্ধ মন্দিরের উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে নিয়মিত আসা যাওয়া ও গোপন মেলামেশা করতেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগকারী এই চরিত্রহীন নারী কর্মকর্তাকে প্রধান কার্যালয় থেকে অপসারণ করে বদলিকৃত পরিবেশ রক্ষামূলক প্রকল্পে পদায়ন করা ও তার অপকর্মগুলোর বিভাগীয় তদন্ত ও শাস্তির দাবি তুলেছেন। এ বিষয়ে (সহকারী কেমিস্ট) ফাওজিয়া রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলবেন না বলে লাইন কেটে দেন। 

ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন : ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহম্মদের স্ত্রী সাজেদা আহম্মদের বিরুদ্ধে তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি এক অফিস আদেশের মাধ্যমে দুদক জানায়, ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহম্মদ নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (চলতি দায়িত্ব) পদে কর্মরত রয়েছেন। দুনীতি দমন কমিশন দুদকের অফিস আদেশে বলা হয়, মিসেস সাজেদা আহম্মেদ এর আয়বহির্ভূত স্বনামে/বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি এর ০০.০১.০০০০.৫০২.০১.০৮৯.১৯-৩১৩৪ স্মারক থেকে আরও জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন  ২০০৪ (২০০৪ সালের ৫ নং আইন) এর ধারা ২৬ এর উপ ধারা (১) দ্বারা অর্পিত ক্ষমতাবলে মিসেস সাজেদা আহম্মেদকে নিজের, নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের স্বনামে বা বেনামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি, দায় দেনা, আয়ের উৎস ও সম্পত্তি অর্জনের বিবরণী প্রদানের জন্য বলা হয়েছে।

জানা গেছে, ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তিনি মাস্টারশীপ পরীক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগ আছে প্রতিটি মাস্টারশীপ পরীক্ষায় একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে বিপুল অংকের উৎকোচ গ্রহণ করছেন বলে অভিযোগ আছে, উৎকোচের বিনিময়ে পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্নপত্র চলে যায় পরীক্ষার্থীদের হাতে। 

এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (চলতি দায়িত্ব) ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে। তিনি দৈনিক আমার বার্তাকে বলেন, আমি কিছু বলতে পারবো না। আমাদের সবকিছু এখন নতুন মহাপরিচালক স্যার দেখছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো জানান, দুদকে মামলার বিষয়ে কোনো কথা বলবো না। 

এই বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। 

এবি/ জিয়া