কৃষির আধুনিকায়নে আসছে ২৫ বছরের মহাপরিকল্পনা
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:৩৯ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন:

দেশের কৃষিকে দীর্ঘমেয়াদে আধুনিক ও টেকসই রূপ দিতে সরকার ২৫ বছরের একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে। ভবিষ্যতের ঝুঁকি, প্রযুক্তির অগ্রগতি- সবকিছু মিলিয়ে এ সমন্বিত কাঠামো তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী ডিসেম্বরেই এর চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হয়ে যাবে।
বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) ‘কৃষি ও খাদ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব তথ্য জানান কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের (বিএজেএফ) আয়োজনে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সম্মেলনটি হচ্ছে। প্রথম দিনের বিষয়বস্তু ছিল- ‘কৃষির রূপান্তর: দেশীয় উপযোগী কৃষিযন্ত্র ও কৃষিপণ্য রপ্তানির চ্যালেঞ্জ’।
সচিব জানান, ১৩টি মূল খাত এবং এর অধীন অসংখ্য উপখাতকে সামনে রেখে পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৭টি সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্যও আলাদা ২৫ বছর মেয়াদি রোডম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদে কয়েকটি পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পও নেওয়া হবে। তবে প্রতিটি প্রকল্পই বিশদ গবেষণা ও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নেওয়া হবে।
>> সারের খরচ সাশ্রয়
অনুষ্ঠানে সার ব্যবস্থাপনা সংস্কার নিয়ে সচিব বলেন, ‘আমরা এমন একটি নীতি প্রণয়ন করছি যাতে প্রতি বছর দুই-তিন হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। চলতি বছর সাশ্রয় হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ৬০০ কোটি টাকা ফেরত গেছে সরকারের কোষাগারে। ২০ কোটি দিয়ে পুরো প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবজির দাম কেজি ১০০ টাকা হলে কেউ কথা বলেন না, কিন্তু পেঁয়াজের দাম ১০০ হলেই আলোচনার ঝড় ওঠে। কৃষক কি ন্যায্য দাম পাবেন না?’ আগামী তিন বছরের মধ্যে আদা ও পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যও তুলে ধরেন তিনি। একই সঙ্গে আলুর দাম না পেয়ে কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনায় তীব্র আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
>> কৃষিযন্ত্রে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’
সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) যান্ত্রিক ধান চাষাবাদ প্রকল্পের পরিচালক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয়ভাবে কৃষিযন্ত্র তৈরির পূর্ণাঙ্গ ইকোসিস্টেম তৈরি করছে ব্রি। শ্রীলঙ্কা, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তিগত সহায়তায় এখন দেশেই মানসম্পন্ন কৃষিযন্ত্র তৈরি হচ্ছে। যা সময়, ব্যয়, শ্রম-সংকট- সব ক্ষেত্রেই যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।
তিনি জানান, মাঠপর্যায়ে উদ্যোক্তা সৃষ্টি, মেকানিক প্রশিক্ষণ, সার্ভিস হাব, খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ- সব মিলিয়ে একটি সমন্বিত কাঠামো তৈরিতে কাজ করছে ব্রি।
>> যে কারণে থেমে আধুনিক কৃষিযন্ত্র উৎপাদন
দেশে আধুনিক কৃষিযন্ত্র উৎপাদনের বড় বাধাগুলোর দিকে আঙুল তোলেন ব্রি–এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দুরুল হুদা। তার ভাষায়, হালকা প্রকৌশল খাতের অদক্ষতা, সিএনসি-ভিত্তিক প্রযুক্তির অভাব, দক্ষ জনবল সংকট- সব মিলিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তারা আন্তর্জাতিক মানের কম্বাইন হারভেস্টার বা রাইস ট্রান্সপ্লান্টার তৈরি করতে পারছেন না।
তিনি দুঃখ করে বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও দেশে ইঞ্জিন তৈরির মতো রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারেনি। পুরোনো শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিল্পভিত্তিও দুর্বল হয়েছে।
>> কৃষিকে লাভজনক পেশায় রূপান্তর
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, কৃষিকে কেবল উৎপাদনের খাত হিসেবে দেখলে হবে না, একে লাভজনক, সম্মানজনক ও শিক্ষিত পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তিনি জানান, পিকেএসএফের সহযোগী সংস্থাগুলো মাঠপর্যায়ে বছরে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করে, যার ৪০ শতাংশই কৃষি খাতে যায়। দেশের কৃষি অর্থায়নের প্রায় ৮৫ শতাংশই এমএফআই (ক্ষুদ্র ঋণ) খাতের মাধ্যমে হচ্ছে।
>> ধান উৎপাদনে বিপ্লব
ব্রি মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, স্বাধীনতার পর খাদ্যনিরাপত্তাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। তখন প্রতি হেক্টরে দেড়–দুই টন উৎপাদন হতো। এখন অনেক জায়গায় তা আট থেকে ১০ টন ছাড়িয়ে গেছে। হাইব্রিড জাতের উন্নয়ন ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে ভবিষ্যতে গড় ফলন ১০ টনের ওপরে যাবে।
>> রপ্তানিতে বড় সম্ভাবনা
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাতে বিশ্ব বাজার চার ট্রিলিয়ন ডলারের। আমাদের দেশে বাজার মাত্র এক বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে আমাদের অনেক সুযোগ রয়েছে। প্রক্রিয়াকরণ খাতে বৈচিত্র্যের অভাব আছে। খাতেও কিছু দুর্বলতা রয়েছে। ৪০০ প্রতিষ্ঠান থাকলেও সবাই উন্নত মানের পণ্য উৎপাদন করতে পারে না।’
তিনি জানান, কৃষি পণ্য রপ্তানিতে ১৮টি দপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হয়। এটি খরচ ও সময় সাপেক্ষ। এজন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে। কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং করতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে থাকা দূতাবাসকে কাজে লাগাতে হবে। বাণিজ্যিক কূটনীতিতে অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের আরও বেশি কাজ করতে হবে।
কামরুজ্জামান কামাল আরও বলেন, ‘কৃষি পণ্য রপ্তানিতে মান নিয়ন্ত্রণ সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগারের স্বল্পতা রয়েছে। অনেক পণ্য ভারত ও সিঙ্গাপুর থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনতে হয়। বিএসটিআইয়ের মান বিশ্বের অনেক দেশ গ্রহণ করে না। এক্ষেত্রে মান প্রণয়নে আমাদের আরও উন্নতি ঘটানো উচিত। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে গ্রাম পর্যায় থেকেই আমাদের কাজ করতে হবে।’
আমার বার্তা/এমই
