সাবেক সিইসিদের পরিণতি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো বর্তমান সিইসিকে

প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:৩১ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংলাপ করছে নির্বাচন কমিশন।

বিতর্কিত নির্বাচন করার দায়ে কারাগারে রয়েছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ও নুরুল হুদা। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে পরিণতি কী হয়, সে কথা প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনসহ অন্য নির্বাচন কমিশনারদের মনে করিয়ে দিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বুদ্ধিজীবীরা।

রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) নির্বাচন ভবনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আয়োজিত সংলাপে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন তারা। এসময় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বুদ্ধিজীবীরা নাসির কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সাহস দেখানোর পরামর্শ দিয়ে প্রয়োজনে পদত্যাগেরও আহ্বান জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, অনেক অর্জন থাকার পরও আমরা খুব দুঃখী ও দুর্ভাগা। কারণ আমরা এখনো নির্বাচন প্রক্রিয়া ঠিক করতে পারিনি। কেন একটি জাতি ও রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়? যে রাষ্ট্র তার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে না, সে জাতি ব্যর্থ হয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাবেক তিন প্রধান বিচারপতির পরিণতি আপনারা দেখেছেন। একজন প্রধান বিচারপতিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে ৫ আগস্টের আগে। আরেকজনকে মব করে বের করে দেওয়া হয়েছে ৫ আগস্ট। আরেকজন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এখন কারাগারে।

‘আপনারা সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের পরিণতিও দেখেছেন। মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, সংসদ- বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান কিন্তু নেই। পুলিশের ওপর মানুষের কোনো আস্থা নেই। এমন অবস্থায় কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ, যদি মেরুদণ্ড থাকে, যদি সাহস থাকে, তবেই স্বাধীন হতে পারবেন।’

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, গত ২০ বছরে সব পেশা- শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, রাজনীতি কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। সব পেশার মর্যাদা শেষ করে দেওয়া হয়েছে। সব ভেঙে গেছে। কারও প্রতি কারও কোনো আস্থা বা বিশ্বাস নেই। গতবারও এসেছি, বলেছি। তারা কিন্তু সেই সাহস, মেরুদণ্ড দেখাতে পারেননি। তারা পরিণতি ভোগ করেছেন। সংলাপের দরজা কোনো দিন বন্ধ হয় না। শেষ পর্যন্ত খোলা রাখতে হয়- এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। পুরো পৃথিবী বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। কমিশনকে স্বাধীন ও স্বচ্ছ হতে হবে। আমরা সেটা দেখতে চাই। আইনশৃঙ্খলা কীভাবে রিস্টোর করে কাজ করবেন, এটা বড় চ্যালেঞ্জ। সীমাহীন দুর্নীতির জায়গায় (ভালো) নির্বাচন করতে হবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে হবে। আচরণবিধি ভাঙলে দৃশ্যমান শাস্তি আমরা বড়ভাবে দেখিনি। দুর্নীতির জায়গাটা দেখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, নেপালে সবেমাত্র রেজিম চেঞ্জ হয়েছে- সোশ্যাল মিডিয়া আটকে দিয়ে। তাই খোলা রাখতে হবে। আলো ঠেকানোর জন্য জানালা বন্ধ করবেন না, ধুলা ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নাগরিক সমাজ, পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সোচ্চার নাগরিক সমাজ জবাবদিহির জায়গা তৈরি করবে। পৃথিবীর সব সরকার মিথ্যা বলে। সাংবাদিকরা ভুল-ত্রুটি ধরে শোধরানোর চেষ্টা করবে। নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু, চা শ্রমিক, বেদে সম্প্রদায়- তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। সাহসের কোনো বিকল্প নেই। সাহস থাকলে স্বাধীন হতে পারবেন।

সাংবাদিক ও কলামিস্ট সোহরাব হাসান বলেন, আমরা কারিগরি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে কম আলোচনা হয়েছে। আমাদের একটা ধারণা হয়েছে যে, পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছেন-সব কিছুর দায় তাদের। আমরা অন্যায় করবো, অনিয়ম করবো, ভোট জালিয়াতি করবো, চুরি করবো- কিন্তু ইসিকে কাজটা করতে হবে। এটা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, ইসির প্রতি আমাদের আস্থা আছে কি না- তার চেয়ে বড় কথা হলো বর্তমান নির্বাচন কমিশন মনে করে কি না যে বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। যদি মনে করে তাহলে পরবর্তী নির্বাচনের দায় নিতে হবে। যদি মনে না করে তাহলে আগামী পাঁচ মাসে সরকারের কী করা উচিত তা জনসম্মুখে জানাতে হবে। তাহলে ইসির প্রতি জনআস্থা আসবে।

সোহরাব হাসান আরও বলেন, নির্বাচন করে জনগণ। কিন্তু জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকার, ইসি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তারা সহায়তা না করলে সম্ভব নয়। আপনাদের যেমন নির্বাচন করার মানসিকতা থাকতে হবে, তেমনই নির্বাচন না করার মানসিকতাও থাকতে হবে। যদি মনে করেন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় তাহলে নির্বাচন থেকে সরে আসা উচিত, আপনাদের পদত্যাগ করা উচিত। বিগত ইসিকেও একই কথা বলেছিলাম। নির্বাচন মানেই উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা। সেটা না থাকার যথেষ্ট পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো জিততেই হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় যে শক্তি আসবে আমরা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো। কিন্তু আমরা তো সেই শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। সব প্রার্থী একই মঞ্চে প্রচার করবে এমন ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কালো টাকার প্রভাব কমবে।

তিনি বলেন, কিছু দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করার প্রস্তুতি চলছে। একটি পক্ষকে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। ঐকমত্য কমিশনের ৩০ দলের সঙ্গে কথা হচ্ছে। সেখান থেকেও কেউ যদি বলে নির্বাচনে যাবে না, তাহলে পরিস্থিতি কী হবে সে বিষয়টা ভাবতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন সেরা নির্বাচন হবে। তাহলে কাউকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে সেরা নির্বাচন কীভাবে হবে?

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ৫৫ বছর পরও নারীদের জন্য মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ আসনের কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের ন্যূনতম দাবি ৩৩ শতাংশ আসন নারীদের জন্য নিশ্চিত করা। এছাড়া প্রবাসীদের সন্তানরা পড়াশোনার জন্য দেশে থাকে। তাদের নিরাপত্তা ও অংশগ্রহণও গুরুত্ব দিতে হবে।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ হারুন চৌধুরী বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে ভোটাররা যেন নিরাপত্তা পায়, তা এখনই দৃশ্যমান করতে হবে। অনেক প্রার্থী পোলিং এজেন্ট দিতে পারেন না। বড় দলগুলো ভয়ভীতি দেখায়। এটা যেন না হয় তা কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জারিফ রহমান বলেন, অদৃশ্য একটা ভয় নির্বাচনের আগে বিরাজ করে। ভোটের আগে দাগি আসামিরা যেন অংশ নিতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচন-পরবর্তী নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেন বজায় থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার ঠেকাতে ফ্যাক্ট-চেকিং ও কুইক রেসপন্স টিম গঠন করতে হবে।

নির্বাচনী সংলাপে সমাপনী বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, আমরা নির্বাচন স্বচ্ছ করতে চাই। সবাই যাতে দেখতে পারে সে ব্যবস্থা করতে চাই। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাবো। দেশীয় পর্যবেক্ষক যতটা পারি বেশি নিবন্ধন দিতে চাই। আমরা চেষ্টা করবো আপনাদের পরামর্শ বাস্তবায়ন করার। অতীতের মতো হবে না। অনিয়ম হলে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা ফিরিয়ে এনেছি।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে সংলাপের আয়োজন করে আসছে ইসি। গত তিন নির্বাচনেও সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও অংশীজন অভিযোগ করেছে যে সংলাপ-পরবর্তীসময়ে তাদের পরামর্শ বা মতামত আমলে নেয়নি কমিশন।


আমার বার্তা/এমই