সপ্তাহের ব্যবধানে ডেঙ্গুতে কেড়ে নিলো দুই ভাই-বোনের প্রাণ
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৩, ১৪:৫৫ | অনলাইন সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

কারও টাকা পয়সা, বাড়ি-গাড়ি বিলাসিতার অভাব কিন্তু অনেকের মত মোহাম্মদ ইব্রাহিমের অভাব এগুলো না, তার অভাব দুটি সন্তানের। এক সপ্তাহের ব্যবধানে মা-বাবার কাছে থেকে ভাইয়ের পর বোনও চলে গেলা অজানা এক দেশে, সেখান থেকে আর ফিরে আসবেনা মা বাবার বুকে।
পুতুল, রংপেনসিল, বই–খাতা, ছোট ছোট জামা, জুতা—ঘরে সবই আছে। নেই শুধু এগুলোর দেখার কোন মালিক, আর এগুলোর মালিক ছিলেন আরাফাত হোসেন রাউফ আর ইসনাত জাহান রাইদা। নেই এই দুজনের খুনসুটি। মায়ের বকুনি থেকে ভাইকে বা বোনকে বাঁচানোর জন্য একজোট হওয়ার কৌশল।
গত ১৮ আগস্ট আরাফাত হোসেন রাউফ আর ২৫ আগস্ট ইসনাত জাহান রাইদা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এই দুই সন্তান নিয়ে মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি রাজধানীর মধ্য পাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের এক বাসায় থাকতেন। এখন এ বাসায় শুধুই পিনপতন নীরবতা। ডেঙ্গুতে দুই ছেলে–মেয়েকে হারিয়ে এই বাবা–মা বেশিক্ষণ ঘরে থাকতে পারেন না।
কোনো না কোনো আত্মীয়ের বাসা বা সাভারের হেমায়েতপুরে চলে যান, যেখানে পাশাপাশি দুই ভাই–বোনকে কবর দেওয়া হয়েছে। বাসার কাছেই আইকন একাডেমি নামে একটি স্কুলে আরাফাত হোসেন কেজি আর রাইদা নার্সারিতে পড়ত। আরাফাতের বয়স ছিল ৯ বছর আর রাইদার ছিল সাড়ে ৬ বছর।
দুই শিশুর পরিবারের অভিযোগ, মধ্য পাইকপাড়ার অনেক বাড়িতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ ছিটানো হয় না নিয়মিত। এমন মর্মান্তিক ঘটনা কারও পরিবারে না ঘটে– এই প্রার্থনা করেছেন দুই শিশুর মা-বাবা।
স্বজনরা জানান, রাউফের লাশ সাভারের হেমায়েতপুরে দাফন করা হয়। ওই এলাকায় ইব্রাহিমের কিছু জমি-জমা রয়েছে। যদিও তাঁর গ্রামের বাড়ি ভোলা। যে রাতে ছেলে মারা যায়, সেই রাতে মেয়ে রাইদার জ্বর আসে। সেই রাতে ঢাকায় ফিরে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয় রাইদার। পরদিন তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। ডেল্টা ও ইবনে সিনা হাসপাতাল ঘুরে সিট না পেয়ে দালালের মাধ্যমে রাইদাকে ১৯ আগস্ট ভর্তি করা হয় ধানমন্ডির রেনেসাঁ হাসপাতালে।
দুই শিশুর বাবা মায়ের অভিযোগ, রেনেসাঁ হাসপাতালে পাঁচ দিন রেখে সঠিকভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি তাঁর মেয়ের। সুস্থ হয়ে গেছে জানিয়ে ২৪ আগস্ট রেনেসাঁ হাসপাতাল থেকে রাইদাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। বাসায় আনার পর আবার তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নানা সমস্যা ধরা পড়ে। এর পর ওই দিন তাকে মহাখালীর ইউনিভার্সেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পিআইইউসিতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। দামি দামি সব ধরনের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল। কোনো কিছুতে আর মেয়েকে ফেরানো যায়নি। ২৫ আগস্ট সকালে চোখের সামনে মেয়েও চলে গেল।
দুই সন্তানের মা-বাবার অভিযোগ, রেনেসাঁ হাসপাতালে পিআইইউসিতে পাঁচ দিন রেখে তাঁর সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই হাসপাতালে ভর্তির দিন চিকিৎসায় অবহেলার কথা বলে হাসপাতাল ছাড়তে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, পার্টির মাধ্যমে এসেছেন; অন্তত পাঁচ দিন থাকতে হবে। চিকিৎসায় অবহেলা ও ঘরে ছড়িয়ে থাকা সন্তানের বইখাতা দেখিয়ে কান্না থামাতে পারছিলেন না দম্পতি।
বাবা মোহাম্মদ ইব্রাহিম বললেন, ‘ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ছেলে–মেয়ে দুজনকেই তো হারিয়ে ফেললাম।’ ঘরের যেখানে হাত দেন, সেখানেই ছেলে–মেয়েদের নিয়ে নানা স্মৃতির কথা বলছিলেন এই বাবা। খাবার টেবিলে বাবার দুই পাশে দুজন বসত, মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হতো। কোলবালিশ দেখিয়ে বললেন, কোলবালিশ মাথায় দিয়ে তাঁকে শুতে হতো, এক হাতের ওপর মেয়ে, আরেক হাতের ওপর ছেলে ঘুমাত।
এই বাবা বললেন, ‘আমার টাকাপয়সা খুব বেশি নেই। যেটুকু ছিল বা সামর্থ্য অনুযায়ী ছেলে–মেয়েদের নিয়ে সুখে থাকতে চাইতাম। প্রতি শুক্রবার স্ত্রী ও দুই ছেলে–মেয়েকে নিয়ে বের হতাম। বাইরে ঘুরে, খেয়েদেয়ে বাসায় ফিরতাম।’
ছেলে–মেয়েদের নিয়ে প্রথমে রিকশায় ঘুরতেন জানিয়ে মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ঘোরার সুবিধার জন্য মোটরসাইকেল কেনেন। কিন্তু মোটরসাইকেলে জায়গা না হওয়ায় গাড়ি কিনেছিলেন শুধু ছেলে–মেয়েদের নিয়ে মনমতো ঘুরতে পারবেন বলে।
‘এখন আর শুক্রবারে আমাদের করার কিছু রইল না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন এই বাবা।
ইব্রাহিম কিছুদিন আগে এক হোটেলে খেয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, হোটেলের খাবার অনেক মজার। তাই ভেবেছিলেন, স্ত্রী ও ছেলে–মেয়েকে নিয়ে ওই হোটেলে খেতে যাবেন। তা–ও তো হলো না। ছেলে–মেয়ের অ্যাকুয়ারিয়ামে দুটো মাছ ছিল। ছেলে–মেয়ে দুটোকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াতে গিয়ে মাছ দুটোও মরে গেছে। এই মা–বাবা ভাবছেন, মাছগুলোও হয়তো চোখের সামনে থেকে ছেলে–মেয়ে দুটো নাই হয়ে গেছে, সেই শোক সইতে পারেনি বলেই মারা গেছে।
১৫ আগস্টেও এই দম্পতি ছেলে–মেয়েদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলেন। সন্তানদের সঙ্গে সেদিনই তাঁরা শেষ ছবি তুলেছিলেন। রাবেয়া আক্তার মুঠোফোনটি কাছে এনে ছবি দেখিয়ে বললেন, মেয়েটা লম্বায় প্রায় মায়ের সমান হয়ে গিয়েছিল। এই যে দেখেন, ছেলেটা তার মাকে চুমু দিচ্ছে। তারপর একা একাই বললেন, ‘বাসায় তো প্রায় সময় আমরা তিনজনই থাকতাম। কত মজা করতাম! ছবি তুলতাম। ভিডিও করতাম। এখন এই ঘরে আমি একা কীভাবে থাকব?’
১৪ আগস্ট আরাফাতের হালকা জ্বর আসে। ১৫ আগস্ট এলাকার এক চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়। ১৬ আগস্ট রক্তের পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। প্লাটিলেট ভালো থাকায় চিকিৎসক বলেছিলেন, হাসপাতালে নেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু পরের দিন ১৭ আগস্ট প্লাটিলেট দ্রুত কমতে থাকে। ১৮ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি করার আগেই আরাফাত মারা যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা জানান, ছেলে মারা গেছে।
মোহাম্মদ ইব্রাহিম বললেন, ‘ছেলেটা চিকিৎসা করানোর কোনো সুযোগই দিল না। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর আমি আর আমার স্ত্রী ভেবেছি, হয়তো আমরা তার চিকিৎসায় কিছুটা হলেও অবহেলা করেছি। তাই মেয়ের ডেঙ্গু পজিটিভ হলে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। কিন্তু হাসপাতালে শয্যা নেই, শিশুদের পিআইসিইউ নেই, পাগলের মতো কত জায়গায় ঘুরলাম। ছেলে মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার পরও কোনো কোনো হাসপাতাল আমাদের জিম্মি করে রাখল। চিকিৎসকেরা যখন যা লাগবে বলেছেন, তা–ই করেছি, কিন্তু মেয়েকেও ফেরাতে পারলাম না।’
আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল ছেলে আরাফাতের জন্মদিন। ছেলেটার ৯ বছর বয়স হতো। ছেলে উড়োজাহাজে করে সিলেট গিয়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিল। তা আর হলো না।
এবি/ওজি