আসামে জনসংখ্যার থেকে দুই শতাংশ বেশি আধার কার্ড
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১৫:১৪ | অনলাইন সংস্করণ
ডয়চে ভেলে

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ঘোষণা করেছেন, আগামী ১ অক্টোবর থেকে রাজ্যে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে কোনও প্রাপ্তবয়স্ককে আর প্রথমবারের মতো আধার কার্ড দেওয়া হবে না।
তার দাবি, রাজ্যের জনসংখ্যা থেকে দুই শতাংশ বেশি আধার দেওয়া হয়ে গেছে এবং বহু অবৈধ ‘বাংলাদেশি’ এই সুবিধা নিয়েছে। এসব আটকাতেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে এক বছরের জন্য ছাড় পাচ্ছে বিশেষ কিছু জনগোষ্ঠী।
হিমন্তের দাবি, আসামের মোট জনসংখ্যা থেকে দুই শতাংশ বেশি আধার কার্ড ইস্যু করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, শেষ জনগণনা অনুযায়ী আসামের মোট জনসংখ্যা তিন কোটি ৭৩ লাখ। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা না হলেও ধরে নেওয়া হয় তা সাড়ে তিন কোটির আশপাশে। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি সত্য় হলে ধরে নিতে হয়, আসামের আধার কার্ড দেওয়া হয়েছে সাড়ে তিন কোটিরও বেশি।
হিমন্ত বলেছেন, “বাংলাদেশে গতবছর সরকার বদলের পর থেকে আসামে অনুপ্রবেশের মাত্রা বেড়েছে। আমরা প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের আটক করে ফেরত পাঠাচ্ছি। তবে আমাদের এত চেষ্টার পরেও একটা বড় অংশ পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ঢুকে পড়ছে এবং আমার বিশ্বাস তারা নকল নথি বানিয়ে এখানেই থাকছে। এর সঙ্গে একটা সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে এই দুই শতাংশ বেশি আধার কার্ডের। তাই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপাতত ১৮ বছর পেরিয়ে যাওয়া মানুষদের নতুন করে আধার কার্ড দেওয়া হবে না। তবে আমরা আপাতত একমাস সময় দিয়েছি, যেসব ভারতীয় আধার কার্ড এখনও বানাননি, তারা এই সময়ের মধ্যে আধারের জন্য দরখাস্ত করতে পারবেন।”
গত সপ্তাহে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সেপ্টেম্বরের এক থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত এক মাসের বিশেষ সময়সীমা থাকবে, যাতে যেসব প্রাপ্তবয়স্ক এখনও আধার কার্ড পাননি তারা আবেদন করতে পারেন। এরপর থেকে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে কারও জন্য আর নতুন আধার দেওয়া হবে না। তবে চা বাগানে কাজ করা জনগোষ্ঠী, তপশিলি উপজাতি এবং পার্বত্য উপজাতি সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এই নিয়ম চালু হবে না। তাদের জন্য অতিরিক্ত এক বছর সময় দেওয়া হবে। এর বাইরেও কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে আধার পাওয়ার সুযোগ থাকবে, তবে তা জেলাশাসকের অনুমতিসাপেক্ষে দেওয়া হবে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “যদি কোনও প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক কোনও কারণে বাদ পড়ে থাকেন, তবে তাকে জেলাশাসকের দপ্তরে আবেদন করতে হবে। জেলা শাসক পুলিশ সুপার এবং বিদেশি ট্রাইব্যুনালের মতামত নিয়ে প্রয়োজন মনে করলে আধার ইস্যু করতে পারবেন।”
সরকারের দাবি, বাংলাদেশ থেকে অতিরিক্ত অনুপ্রবেশ আসামের জনবিন্যাস পাল্টে দিচ্ছে। বহু জায়গায় স্থানীয় মানুষ কাজের সুযোগ, জমি ইত্যাদি হারিয়েছেন। অবৈধ বিদেশিরা বিভিন্ন জায়গায় সরকারি জমি দখল করে রেখেছে এবং তাদের উচ্ছেদ করতে যে অভিযান শুরু হয়েছে সেখানে ১২-১৫ হাজার মানুষ জড়ো হয়ে সরকারি কর্মীদের উপর হামলা করেছে। গত মাসে গোলাঘাটের উরিয়ামঘাটে উচ্ছেদ অভিযানের সময় একদল মানুষ সরকারি কর্মচারীদের তাড়া করেন বলে অভিযোগ। পুলিশ এসবের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ গুলি চালায় এবং এক স্থানীয় যুবক নিহত হয়।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, উরিয়ামঘাটে সরকারি কর্মচারীদের উপর হামলা সাধারণ ঘটনা ছিল না, এর পেছনে বড় ষড়যন্ত্র রয়েছে। যারা হামলা করেছিল তারা দূর দূরান্ত থেকে ওই এলাকায় আগেই জোড়ো হয়েছিল। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের নাম স্থানীয় ভোটার তালিকায় নেই, তাই আমাদের সন্দেহ আরো পরিষ্কার হয়েছে। এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের আসামের সাধারণ মানুষের মধ্যে ঢুকে পড়া আটকাতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে আমাদের। আধার কার্ড না দেওয়া তারই অংশ। তবে এটি সম্পূর্ণভাবে একটি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। কারো ধর্ম বা সম্প্রদায় দেখে নয়, আমরা বয়স দেখে আটকাচ্ছি। আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য— কোনও বিদেশি যেন ভবিষ্যতে আধার কার্ড পেয়ে ভারতের নাগরিকত্বের দাবি করতে না পারে। আসামকে অনুপ্রবেশ থেকে সুরক্ষিত রাখাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
ভারতে আধার কার্ড এখন নিত্যনৈমিত্তিক কাজে প্রয়োজন হয়। পড়াশোনা থেকে চিকিৎসা, ব্যাংক থেকে ব্যবসা, এমনকি সাধারণ নির্মাণ কাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হলেও এখন আধার কার্ড দেখানো বাধ্যতামূলক। ভারতের অন্য কোনও রাজ্য এর আগে আধার ইস্যু বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়নি। আইনজীবীরা বলছেন, আধার এবং নাগরিকত্বের মতো বিষয়ে রাজ্যের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার নেই। এই অধিকার শুধুমাত্র কেন্দ্রের।
গৌহাটি হাইকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, “সরকার হয়তো মন্ত্রিসভার বৈঠকে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে এটি চালু করার অধিকার রাজ্যের নেই। রাজ্যের সরকার কেন্দ্রের কাছে এ ব্যাপারে আবেদন করতে পারে এবং কেন্দ্রকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হলে আধারের নিয়ম মেনে নিতে হবে। এভাবে হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।”
তার দাবি, আসামের সরকার অতীতেও এমন অনেক কথাই বলেছে, যেগুলো তাদের আওতার বাইরে। এর পেছনে একটাই কারণ, সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিতর্ক তৈরি করা। যার ফলে প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলোচনা বন্ধ থাকে।
শ্রীভূমি জেলার ফরেনার্স ট্রাইবুনালের প্রাক্তন সদস্য (বিচারক) শিশির দে জানিয়েছেন, একটা বিশেষ নিয়মের অধীনে এই আধার কার্ড দেওয়া শুরু হয়েছিল। তবে প্রথম দিকে আসাম এই প্রক্রিয়ায় যোগ দেয়নি, এখানে অনেক পরে আধার কার্ড সেন্টারগুলো চালু হয়। অথচ কেন্দ্রীয় স্তরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তখন আধার বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় আসামের অনেকেই অন্যান্য রাজ্যে গিয়ে আধার কার্ড বানিয়েছেন। কারণ আধার রুলস্ বলছে, এই কার্ড দেশের যে কোনো রাজ্যে বানানো যায়। রাজ্যের দায়িত্ব বা অধিকার একটাই, তারা আধার কার্ড বানানোর পরিষেবা দেবে।
শিশির বলেন, “একসময় আসামে আধার কার্ডের আবেদন করা যেত না বলে রাজ্যের মানুষ ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে এটি বানিয়েছেন। এবার যদি আসামের সরকার এটি আটকে দেয়, যাদের কার্ড প্রয়োজন তারা অন্যান্য রাজ্যে গিয়ে বানাতে পারবেন। অর্থাৎ রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের সেই অর্থে কোনো প্রভাব পড়বে না। মুখ্যমন্ত্রী অযথা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তার বোঝা উচিত, কিছু কিছু সিদ্ধান্ত তার ক্ষমতার বাইরে।”
আধার কার্ড ইস্যু করে কেন্দ্র সরকারের অধীনে থাকা একটি বিশেষ বিভাগ। যার নাম ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (ইউআইএডিএআই)। আধার পাওয়ার ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আবেদনকারীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট এবং চোখের রেটিনা স্ক্যান। নিয়ম অনুযায়ী এর সঙ্গে নাগরিকত্বের সরাসরি সম্পর্ক নেই, যারা অন্তত ১৮০ দিন ভারতের থাকার প্রমাণ দিতে পারবেন, তারা এই কার্ড সংগ্রহ করতে পারেন।
২০১৮ সালে আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) প্রথম তালিকা প্রকাশ হয়েছিল। সেখানে ৪০ লাখ মানুষ বাদ পড়েছিলেন। বাদ পড়া ব্যক্তিদের বলা হয়েছিল, তাদের বায়োমেট্রিক অর্থাৎ হাতের ছাপ এনআরসি কেন্দ্রে এসে নথিভুক্ত করতে। সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ইউআইএডিএআই-কে।
৪০ লাখের মধ্যে ২৬ দশমিক ছয় লাখ মানুষ এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। এক বছরের মাথায়, অর্থাৎ ২০১৯ সালের অগাস্ট মাসে এনআরসির পরবর্তী তালিকা প্রকাশ হয়। সেখানে বলা হয়, তালিকা থেকে বাদ যাওয়া মানুষের সংখ্যা ১৯ লাখ। তবে ইউআইএডিএআই ২৬ দশমিক ছয় লাখ মানুষের বায়োমেট্রিক (হাতের আঙ্গুলের ছাপ) ফ্রিজ করে দেয়। প্রায় ৮ লাখ মানুষের নাম এনআরসি-তে ফের অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের আধার কার্ড দেওয়া হয়নি প্রায় ছয় বছর। এনিয়ে সুপ্রিমকোর্টে মামলা করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ সুস্মিতা দেবসহ অনেকেই। গতবছর সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এবং ধাপে ধাপে এই ২৬ দশমিক ছয় লাখ মানুষকে আধার দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন রাজ্যের বিরোধীরা। তাদের প্রশ্ন, সরকার যে তথ্য দিচ্ছে, তা যদি ঠিক হয়, সত্যিই যদি রাজ্যের জনসংখ্যার চেয়ে আধারকার্ড বিতরণ বেশি হয়, তাহলে তার দায় কার? এই সরকারেরই প্রশাসন আধার কার্ড বিলি করেছে। তাহলে ধরে নিতে হয়, প্রশাসন ভুয়া নথি তৈরি করেছে এবং তা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিতরণ করেছে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, মৃত ব্যক্তির নথি ব্যবহার করে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের কাগজপত্র তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এর দায় প্রশাসনকে নিতে হবে। যারা একাজ করেছে তাদের শাস্তি দিতে হবে এবং যাদের এভাবে কাগজ দেওয়া হয়েছে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে।
আসাম বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস নেতা দেবব্রত সইকিয়া প্রশ্ন তুলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনের ব্যর্থতা ঢাকতেই কি এই সিদ্ধান্ত নিলেন?”
তার কথায়, “রাজ্য সরকারের অধীনে প্রতিটি জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আধার কার্ড প্রদান করা হয়েছে। যখন অতিরিক্ত আধার জারি হচ্ছিল, সরকার কোথায় ছিল? এই ব্যর্থতার দায় সরকারের। অথচ নিজের দায় মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এড়াতে কাল্পনিক কিছু যুক্তি তুলে ধরেছে। মুখ্যমন্ত্রী যখন নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন, জনসংখ্যার থেকে বেশি আধার তারা প্রদান করেছেন, এবার তার দায়িত্ব গোটা বিষয় তদন্ত করা এবং দোষীদের শাস্তি দেওয়া। তিনি একাজ করবেন না কারণ, এতে তারই কিছু মানুষের নাম বাইরে বেরিয়ে আসবে। বিজেপি নাগরিকত্ব এবং জাতীয় সুরক্ষাকে একটা ছেলে খেলার জায়গায় নামিয়ে এনেছে।”