বান্দরবানে ১১ কোটি টাকার টানেল ২ বছরেই বেহাল
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৪৪ | অনলাইন সংস্করণ
বান্ধরবান প্রতিনিধি(মাল্টিমিডিয়া):

মাত্র দুই বছর আগে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল বান্দরবান বাস টার্মিনালের টানেলটি। অথচ এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই সেটি বেহাল অবস্থায় পরিণত হয়েছে। দেয়ালের ফাটল দিয়ে পানি চুইয়ে পড়া, রাস্তায় ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত, কাদামাটি ও আলোর সুব্যবস্থার অভাবে টানেলটি এখন পথচারী ও গাড়ি চালকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
বান্দরবান শহরের বাস স্টেশন থেকে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে যাতায়াত সহজ করতে তৈরি হয়েছে এই টানেল। আগে এ পথে কাদা ও পাহাড়ধসে চলাচলে ঝুঁকি ছিল। তখন বাসস্টেশন থেকে ট্রাফিক মোড় ঘুরে টার্মিনালে যেতে হতো। সংযোগ সড়ক হিসেবে নির্মাণ শুরু হলেও পরে টানেল আকারে হওয়ায় এটি ‘বান্দরবান বাস টার্মিনাল টানেল’ নামে পরিচিত হয়।
সরজমিনে দেখা গেছে, টানেলের ভেতরে দিনের বেলায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। বর্ষায় দেয়ালের ফাটল দিয়ে ঝর্ণার মতো পানি পড়ে, রাস্তাজুড়ে তা জমে থাকে। সেই পানির সঙ্গে মিশে থাকে কাদামাটি। গাড়ি চলাচলের কারণে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গর্ত। টানেলের প্রবেশমুখেও যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং। অন্যদিকে পাহাড় ধসে মাটি স্তুপ হয়ে পড়ে আছে একপাশে। এর মধ্য দিয়েই প্রতিদিন স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে যাতায়াত করতে হচ্ছে।
টানেলের ফাঁটল চুইয়ে পানি পড়ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে (২০১৮-২০২৩ অর্থবছরে) বাসস্ট্যান্ড থেকে হাফেজঘোনা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল পর্যন্ত ৫০০ ফুট দৈর্ঘ্যের এই টানেলটি নির্মিত হয়। কাজ শুরু হয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। তবে দুই দফা বরাদ্দের পর ২০২৩ সালের অক্টোবরে কাজ শেষ হয়। কাজটি সম্পন্ন করে এম এম ট্রেডার্স লাইন্সেস নামে একটি প্রতিষ্ঠান, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেন ঠিকাদার রাজু বড়ুয়া। তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর টানেলটি উদ্বোধন করেন।
স্থানীয়রা বলছেন, নিম্নমানের কাজ ও অপরিকল্পিত নির্মাণের কারণে দেয়ালে ফাটল ধরেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই কোটি টাকার এই প্রকল্প ধ্বংসের মুখে পড়েছে। নির্মাণকাজে যারা জড়িত ছিল এবং এগুলো তদারকির দায়িত্বে যারা ছিল, তাদেরকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সঠিক তদন্ত করে প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলছেন স্থানীয়রা।
ইসলামপুর ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ রেজা বলেন, “টানেল দিয়ে যাতায়াতে এখন ভোগান্তি ছাড়া কিছু নেই। ভেতরে অন্ধকার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব। মানুষ ভয়ে চলাচল করছে। দেয়াল থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। সে পানি রাস্তা জমাট হয়ে ছোট-বড় গর্ত হয়ে গেছে।”
পথচারী মোহাম্মদ সবুজ বলেন, “টানেলের ভেতরে কাদামাটি জমে থাকে। দীর্ঘদিন লাইট না থাকায় আশপাশের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করতে ভয় পাই। সবসময় অন্ধকার। এই রাস্তা দিয়ে গেলে একটা ভয়ের আশঙ্কার মধ্যে থাকতে হয়।”
বাসচালক সাইফুল ইসলাম টানেলের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে জানান, টানেলের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালানো অত্যন্ত কষ্টকর। বৃষ্টির পানির সঙ্গে মাটি মিশে ইঞ্জিনে কাদা ঢুকে পড়ে, এতে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে যায়। অনেক সময় হঠাৎ করে ব্রেক কাজ করে না, ফলে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অন্যদিকে চলে যায়।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “কোটি কোটি টাকা খরচ করে যদি এমন একটি টানেল তৈরি করা হয়, আর তা কয়েক বছরের মধ্যেই জনগণের জন্য দুর্ভোগে পরিণত হয়, তাহলে এর প্রকৃত উপকারিতা কোথায়? জনগণের সুবিধার জন্য যে টানেল নির্মাণ করা হয়েছিল, সেটাই এখন মানুষের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
টমটম চালক জিশু দাশ ও জীপ চালক মাইকেল বম বলেন, “এই টানেল দিয়ে গাড়ি চালানো এখন অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। দিনের বেলায়ও অন্ধকার। চারপাশে ওয়ালের ফাটল দিয়ে পানি ঝর্ণার মতো পড়ছে, রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় গর্ত। টানেল দিয়ে যাওয়া মানেই ঝুঁকি নিয়ে চলা।”
টানেলের ভেতরের সড়কেও ছোট-বড় গর্ত তৈরি হয়েছে।
টানেলের বেহাল অবস্থার বিষয়ে জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অংচমং মারমা বলেন, “নির্মাণের দুই বছর না যেতেই দেয়ালের ফাঁক দিয়ে পানি পড়ছে। এতে বোঝা যায়, টানেলটি অনেক টাকা ব্যয় করে নির্মাণ করা হলেও কোনোভাবেই মানসম্মতভাবে হয়নি।”
তিনি আরো বলেন, “নির্মাণকাজে যারা জড়িত ছিল এবং এগুলো তদারকি করার যাদের দায়িত্ব ছিল তাদেরকেও জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। তা নাহলে জনগণের টাকায় এত অর্থের ব্যয় করে নির্মাণ করা হল সেটা পানিতে চলে যাবে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আাগামীতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে- কর্তৃপক্ষ সংস্থাকেও জবাবদিহির আনা দরকার।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বান্দরবান ইউনিটের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বিন ইয়াছির আরাফাত বলেন, “এটি মূলত সংযোগ সড়ক হলেও অনেকেই টানেল বলে ডাকেন। আরসিসি ঢালাইয়ের জয়েন্ট থেকে পানি পড়ছে। এটিকে অনেকে টানেল ফেটে পানি পড়ছে বলে অভিযোগ করেন। বৃষ্টিতে মাটি ধসে যায়, জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হলেও সেগুলো চুরি হয়েছে। উদ্বোধনের সময়ের লাইট ও অন্যান্য সামগ্রীও পরবর্তীতে চুরি হয়ে গেছে। বৃষ্টির মৌসুম শেষ হলে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
তিনি আরো বলেন, “প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ১১ কোটি টাকা। বর্তমানে এটি বান্দরবান পৌরসভার কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। টোল আদায় নিয়ে উন্নয়ন বোর্ড ও পৌরসভার মধ্যে আলোচনা চলছে।”