ঢাকার পানিতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুর উপস্থিতি উন্মোচন

প্রকাশ : ২২ মে ২০২৫, ১৪:৪২ | অনলাইন সংস্করণ

  জাবি প্রতিনিধি:

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের এক দল গবেষক ঢাকা ও সাভার অঞ্চলের আটটি ভিন্ন ভিন্ন পানির উৎসে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুর উদ্বেগজনক প্রাদুর্ভাব উন্মোচন করেছেন। এই গবেষণার একটি অংশ বিশ্ববিখ্যাত নেচার পাবলিশিং গ্রুপের npj Clean Water জার্নালে  সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে পানিবাহিত রোগগুলো ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উপর ভারী চাপ সৃষ্টি করছে, সেখানে পানির ভিন্ন ভিন্ন উৎসে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ডায়রিয়ার জীবাণুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ্যতা হচ্ছে শরীরে কোনো জীবাণু  নির্মূলে প্রয়োগকৃত নির্দিষ্ট ওষুধের বিপক্ষে যুদ্ধ করে ঐ জীবাণুর টিকে থাকা বা প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করা, যদিও পূর্বে ঐ নির্দিষ্ট ওষুধের মাধ্যমেই সেই জীবাণুটিকে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করা জীবাণুর সংক্রমণের চিকিৎসা করা দুরূহ, কারণ এজন্য ভিন্ন ধরনের ওষুধের বা নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ উচ্চমাত্রায় সেবনের প্রয়োজন হয়। যার ফলে চিকিৎসা ব্যয়বহুল হয়ে যাওয়াসহ শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি ও অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হয় যা এক পর্যায়ে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য ও উন্নয়নের প্রধান হুমকিগুলোর মধ্যে একটি। ২০১৯ সালে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সরাসরি ১.২৭ মিলিয়ন বৈশ্বিক মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল এবং ৪.৯৫ মিলিয়ন মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত ছিল। এছাড়াও, WHO এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে যে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ২০৫০ সালের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে বার্ষিক মৃত্যুর সংখ্যা ১০ মিলিয়ন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

গবেষকরা হাসপাতাল, শিল্প ও পৌর বর্জ্য দ্বারা দূষিত পানির পাশাপাশি নদী, খাল, পুকুর, লেক ও সেচের প্রাকৃতিক পানি থেকে ৫০ টি পানির নমুনায় বিভিন্ন ধরনের প্রায় ১৫৫টি জীবাণু সংগ্রহ ও পরীক্ষা করেছেন। তাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, এই পানির উৎসগুলতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু, Escherichia coli, Vibrio cholerae, Salmonella spp. Shigella spp. মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে উপস্থিত আছে।

সাধারণত সংক্রমিত প্রাণী বা মানুষের মল দ্বারা দূষিত পানি পানের মাধ্যমে এই জীবাণুগুলোর সংক্রমণ ঘটে। বাংলাদেশে অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং বর্জ্যপানি পরিশোধনের দুরবস্থার কারণে এই জীবাণুগুলো বিভিন্নভাবে খাদ্য এবং পানিতে প্রবেশ করে।

বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১.৭ থেকে ৬ বিলিয়ন ডায়রিয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, যেখানে ছোট বাচ্চারা প্রতি বছর গড়ে তিনবার এ রোগে আক্রান্ত হয়। বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে ডায়রিয়া (০.৭৬ মিলিয়ন বা ১১%)। ঘন ঘন ডায়রিয়ার আরেকটি সাধারণ পরিণতি হচ্ছে অপুষ্টি, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি লক্ষ্য করা যায়। এর ফলস্বরূপ অন্য যেসব দীর্ঘমেয়াদী সমস্যাগুলো হতে পারে তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল শরীর ও মেধার অযথাযথ বিকাশ।

এই গবেষণায় আরেকটা বিশেষ পর্যবেক্ষণ হল  বেশিরভাগ পানির উৎসে মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট বা বহুধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর উপস্থিতি, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জীবাণু পাঁচ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রদর্শন করেছে। পানিতে পাওয়া জীবাণুগুলোর সাথে পূর্বে রোগাক্রান্ত মানুষ ও প্রাণিজ উৎস থেকে সনাক্ত করা জীবাণুর ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং বর্জ্যপানি পরিশোধনের দুরবস্থার কারণে ঢাকার পানির উৎসগুলো ধীরে ধীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিন বহনকারী ব্যাক্টেরিয়া বিস্তারের মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে উঠছে।

ঢাকার সাভারের মত অঞ্চলগুলোতে  কৃষি খামার, গবাদি পশুর খামার, মাছের খামার, হাস মুরগির খামার, গার্মেন্টস, ট্যানারি, ঔষধ কারখানা ও যত্রতত্র হাসপাতাল রয়েছে। এই খামার, কারখানা ও হাসপাতাল বর্জ্যের মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ও অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি পানির বিভিন্ন উৎসে নির্গত হচ্ছে। যা পরবর্তীতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়া বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শুভ্র কান্তি দে ও সহকারী অধ্যাপক নাদিম শরীফ ও তাদের গবেষণা দল বিগত ৩ বছর ধরে এই গবেষণার পরিচালনা করেছেন। তাদের মতে, “আমাদের গবেষণার ফলাফল অত্যন্ত উদ্বেগজনক, কারণ এগুলো ইঙ্গিত করে যে ঢাকা ও সাভার অঞ্চলের পানির উৎসগুলো বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত হচ্ছে। বন্যার সময় অনেকগুল দূষিত উৎসের পানি একত্রিত হয়ে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে ঢাকার ঘনবসতি, বিশুদ্ধ পানির অভাব, এবং অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এই সমস্যাকে আরো প্রকট করে তুলছে। যা কেবল ডায়রিয়ার চিকিৎসার কার্যকারিতাই হুমকির মুখে ফেলছে না, বরং জনস্বাস্থ্যের জন্যও গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।”

গবেষকদল পানির উৎসে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর বিস্তার কমাতে পরিবেশগত পানিতে বর্জ্য পানি নিঃসরণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, ধারাবাহিক নজরদারি ব্যবস্থা, এবং উন্নত বর্জ্য পানি পরিশোধন ব্যবস্থায় বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন। তদুপরি, তাঁরা নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও শিল্পক্ষেত্রের অংশীদারদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই ক্রমবর্ধমান হুমকির বিরুদ্ধে শক্তিশালী কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।

 

আমার বার্তা/সৌরভ শুভ/এমই