আতঙ্কে হল ছাড়ছেন ইবির গণরুমের ছাত্রীরা
প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:১৪ | অনলাইন সংস্করণ
ইবি প্রতিনিধি

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে এক নবীন ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে হলের গণরুমে থাকা ছাত্রীরা নিজ নিজ বাড়ি চলে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও অনেকে পারিবারিক চাপে তারা বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। এই ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী। তিনি নিজেই গণমাধ্যমকে বিষয়টি জানিয়েছেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে হাইকোর্টের নির্দেশের পর সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস ছেড়েছেন অভিযুক্তরা। হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রীকে সাংগঠনিক সব ধরণের কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দিয়েছে শাখা ছাত্রলীগ। শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলের একাধিক ছাত্রী বলেন, ‘গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনায় পরিবার জানতে পেয়ে বাসায় যেতে বলেছে। এছাড়াও হলে একটা আতঙ্ক ও ভীতিকর পরিবেশ তৈরী হয়েছে। পড়াশুনার পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’
ভূক্তভোগী ছাত্রী বলেন, ‘পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছি না কবে মামলা করা হবে।’
প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মৌখিক নির্দেশে অভিযুক্তদের হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছি। তারা সন্ধ্যার পর হল ছেড়ে চলে গেছেন। গণরুমের ছাত্রীরাও অনেকেই হয়তো ভয়ে চলে যেতে পারে। আমি এর বেশিকিছু জানি না।’
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, ‘তদন্ত প্রক্রিয়া চলাকালীন অভিযুক্ত ওই ছাত্রলীগ নেত্রী কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না। তদন্তে তিনি দোষী সাব্যস্ত হলে আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করব।’
উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশ অবগত হয়েছি। আমি ইতোমধ্যে প্রক্টরিয়াল বডি ও পুলিশ প্রশাসনকে ভুক্তভোগী ছাত্রীকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি জানিয়েছি।’
ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেয়েটি কোথায় আছে সেটাই তো আমরা জানি না। খবর নিয়েছি কিন্ত সে হলে নাই। মেয়েটার পরিবারের সঙ্গে আমাদের দেখা করার দরকার ছিল। সে কোথায় আছে, না আছে সেটা এখনও জানি না।’
প্রসঙ্গত, দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে গত ১১ ও ১২ই ফেব্রুয়ারি দুই দফায় ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের এক ছাত্রীকে রাতভর র্যাগিং, শারীরিকভাবে নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করার অভিযোগ উঠে। এই ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও ফিন্যান্স বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তাবাচ্ছুমসহ আরও ৭/৮ জন জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী।
এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার বিচার চেয়ে ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রক্টর ও ছাত্র-উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। একই দিনে অন্তরা ঘটনা মিথ্যা দাবি করে ভুক্তভোগীর ও প্রকাশিত সংবাদের বিচারের দাবিতে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং শাখা ছাত্রলীগ পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি করেছেন।
এদিকে নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিচারের সরব হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাসের ছাত্র সংগঠনগুলোও। ইবি শাখা ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্রদল ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদল বিবৃতি প্রদান, বিক্ষোভ ও মশাল মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন।
পরে বুধবার আইনজীবী গাজী মো. মহসীনের করা রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ বিভিন্ন আদেশ দেন। আদেশে তারা অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাস ছাড়ার নির্দেশ দেন।
এছাড়া আদেশে ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কমিটিতে একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও একজন শিক্ষককে রাখতে বলা হয়েছে। এতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
আদেশ আরও বলা হয়েছে, কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে ৩ দিনের মধ্যে এ কমিটি গঠন করতে হবে। পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে হবে। একসঙ্গে এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের করা কমিটির রিপোর্টও ১০ দিনের মধ্যে দাখিল করতে বলেছেন আদালত। তদন্ত চলাকালীন অভিযুক্ত দুজনকে ক্যাম্পাসের বাইরে রাখতে বলা হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্টদের নির্যাতনের স্বীকার শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
এছাড়া ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী চাইলে এ ঘটনায় মামলা দায়ের করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন আদালত। আর এ বিষয়ের ভিডিও যাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
রুলে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা গ্রহণের নিস্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, এবং এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
এবি/ জিয়া